‘এই রিক্সা ইধার আ, আস্তে করে দাঁড়া’, হঠাৎ ঠাকুমার হিন্দি কেন রুদ্রনীলের মুখে?
Rudranil Ghosh: টানা পাঁচ বছরের অপেক্ষার ইতি। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তি পেতে চলেছে অজয় দেবগণ অভিনীত ছবি 'ময়দান'। কিংবদন্তি ফুটবল কোচ সৈয়দ আবদুল রহিমের জীবনী নিয়ে তৈরি ‘ময়দান’। অজয় দেবগণ সৈয়দ আবদুল রহিমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই প্রথম কোনও ফুটবল কোচের ভূমিকায় তিনি ‘সিংঘম’। আর এই ছবিতেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ।
জয়িতা চন্দ্র
বাংলা, বাংলা অভিনেতা, বাংলার প্রেক্ষাপট, আর ফুটবল, ভাষা বাংলা হবে না? বাংলা বাঙালি ও ফুটবলের সম্পর্কের সমীকরণ এতটাই মজবুত যে, এই প্রশ্ন কিংবা আবদার থাকাটাই স্বাভাবিক। ‘ধন্য়ি মেয়ে’র সেই কাল্ট গানই তো বলেছে, ”সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল।” আর সেই বাঙালির পাতে ফুটবল নিয়ে ছবি, যার ভাষা হিন্দি। প্রাথমিকভাবে অনেকেই অনুমান করেছিলেন, অজয় দেবগণ অভিনীত ‘ময়দান’ বাংলাতেও ডাব করা (Bengali dubbing) হবে। কিন্তু না, তেমনটা হচ্ছে না।
টানা পাঁচ বছরের অপেক্ষার ইতি। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তি পেতে চলেছে অজয় দেবগণ অভিনীত ছবি ‘ময়দান’। কিংবদন্তি ফুটবল কোচ সৈয়দ আবদুল রহিমের জীবনী নিয়ে তৈরি ‘ময়দান’। অজয় দেবগণ সৈয়দ আবদুল রহিমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই প্রথম কোনও ফুটবল কোচের ভূমিকায় তিনি ‘সিংঘম’। আর এই ছবিতেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ। ফলে ‘ময়দান’ ছবির দিকে তাকিয়ে গোটা বাংলা। ছবির প্রাথমিক পোস্টার দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল, অনুমান করেছিলেন ছবিটি বাংলাতেও আসতে চলেছে। অবশেষে উত্তর মিলল: না। বাংলা তথা একশ্রেণির বাঙালিদের মনে প্রশ্ন: কেন বাংলায় নয়? TV9 বাংলা কথা বলল অভিনেতা রুদ্রনীলের সঙ্গে।
কেন বাংলায় ডাবিং হচ্ছে না ময়দান ছবির?
রুদ্রনীল: অনেকের আবেগ কাজ করছে এই ছবির পিছনে। প্রশ্ন তুলছেন, ‘বাংলায় ডাবিং নয় কেন?’ প্রথমত, যে তিনটে ভাষায় ডাব করা হয়েছে এই ছবি, সেই তিন রাজ্যের (দক্ষিণ ভারতের) মানুষ আমাদের থেকে হিন্দিটা অনেক কম বোঝেন। বাংলা এবং বাঙালিরা যথেষ্ট ভাল হিন্দি বোঝেন, তাই এখানে হু-হু করে হিন্দি ছবি চলে। সকলের একটা ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, ‘ময়দান’ মানে কলকাতার ময়দান নয়। চিত্রনাট্যের প্রেক্ষাপটে ঘটনার শুরু কলকাতায়, কিন্তু কলকাতার ময়দানে নয়। এখানে ময়দানকে সার্বিকভাবে ফুটবলের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বোঝানো হয়েছে। সৈয়দ রহিম মহাশয়ের নেতৃতে কীভাবে একবারই ভারত বিশ্বসেরা হয়েছিল, সেই গল্প বলা হয়েছে।
ইন্ডিয়ান ফুডবল ফেডারেশনের অফিস সেই সময় ছিল কলকাতায়। পোস্টারটা ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, বাংলার উল্লেখ রয়েছে, দেখবেন লিলি বিস্কুটের বিজ্ঞাপন, বাংলায় লেখা ট্রাম রয়েছে। আর আমার মনে হয়, ছবিটার তো প্রয়োজনই পড়বে না বাংলা ভাষায় ডাবিং-এর। বাঙালিরা হিন্দিটায় অনেক বেশি সড়গড়। আমরা ‘পাঠান’ দেখে ফাটিয়ে দিচ্ছি। আমরা ‘ডানকি’, ‘টাইগার’, ‘অ্যানিম্যাল’ দেখে ফাটিয়ে দিচ্ছি। প্রচুর ছবির শুটিং-ও তো বাংলার বুকে হয়। শাহরুখ যদি বাংলায় কথা বলেন, ডাবিং হয়, সেটার হিন্দিটা তো দর্শকদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, হয়নি তো কখনও।
মানুষ হয়তো আবেগ থেকে বাংলায় ডাবিংয়ে দাবি করছেন। যেহেতু এটা হিন্দি সিনেমা, ভারতীয় ফুটবলের গল্প, ফলে ছবিতে প্রচুর বাংলা শব্দেরও ব্যবহার আছে, বাংলা বাক্যের ব্যবহার আছে, যতটা প্রয়োজন রাখা তো হয়েছে। দর্শক তো হিন্দি তো বোঝেনই। যেহেতু কলকাতার সংযোগ রয়েছে গল্পে, তাই বহু বাঙালি চরিত্রও রয়েছে। তাঁরা প্রয়োজন মতো বাংলাও বলেন (ছবিতে)। এট যদি ধরে নেওয়া যায়, দক্ষিণভারতের ঘটনা, তাহলে হিন্দিতে সেই ছবি তৈরি হলেও সেখানকার স্থানীয় প্রচুর শব্দ ব্যবহার করা হতো। এটাও তেমনই একটা পদক্ষেপ।
আমার মনে হয়, এতটা আফসোসের কোনও কারণ নেই। এই ছবিটা যদি বাংলায় ডাব করে রিলিজ় করা হত, পাশাপাশি হিন্দি ছবিটাও থাকত, তাহলে আমার বিশ্বাস মানুষ হিন্দিটাই হলে গিয়ে দেখত। কলকাতাকে যতটা মান্যতা দেওয়া প্রয়োজন, ততটাই গল্পে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোথাও কোনও ফাঁক নেই।
তবে কি বাঙালিরা বাংলার থেকে বেশি হিন্দি বুঝে নিচ্ছেন আজকাল। তাই বাংলার বুকে হিন্দি ছবির রমরমা? আর বাংলা ছবি লড়াই করছে…
আমাদের হাতের মুঠোয় ওয়েব চলে আসার পর অনেক কিছুরই বদল ঘটছে। আমরা সেখানে বহু ওয়েব সিরিজ হিন্দিতেই তো দেখছি। সেগুলোকে হিট করাচ্ছি। তার মানে এখন হিন্দিটা অনেক স্পষ্ট করে বাড়ির মানুষেরা বুঝতে পারছেন। আগেকার দিনে ঠাকুমারা বলতেন, ‘এই রিক্সা ইধার আ, আস্তে করে দাঁড়া’। তার মানে সেই প্রজন্মও হিন্দি চর্চা করতেন। তুলনায় হয়তো কম। যখন কোনও ভাষা ধীরে-ধীরে ‘আমার’ হয়ে উঠতে শুরু করে, তখন আমিও ধীরে ধীরে সেই ভাষার গ্রাহক হয়ে উঠতে শুরু করি। যেহেতু হিন্দি ভাষার গ্রাহক সব ভাষার থেকে বেশি (আমাদের দেশের ক্ষেত্রে), তাই তার বাজারও বেশি। চাহিদা রয়েছে। হিন্দি তো আমাদের দেশের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। ফলে এক্ষেত্রে একটু বেশি বিনিয়োগ করা সম্ভব। কারণ সেখানে একটা ভরসা কাজ করে, টাকা উঠে আসবে। কিছুটা হলেও একটা নিশ্চয়তা কাজ করে।
এবার আমরা ওয়েব দেখছি, সেখানে বাংলাতেও যেটা ভাল লাগছে সেটাও যেমন দেখছি, পাশাপাশি হিন্দিটাও দেখছি। তবে একটা হিন্দি সিরিজের গ্রাহক যেহেতু অনেক বেশি, বাংলার কম, তাই যে নির্মাণ যত্নটা হিন্দির ক্ষেত্রে বহন করা সম্ভবপর হয়, সেটা বাংলা চেয়েও পারে না। কারণ পকেটে টান। হিন্দির যা বিনিয়োগ, বাংলা চেষ্টা করলেও তা করতে পারবে না। একটা ছবির পিছনে সঠিক পথে খরচের ওপরই তো তার উপস্থাপনা নির্ভর করে। বাংলায় বিষয়বস্তুর অভাব নেই, পরিচালকের অভাব নেই, শিল্পকলায় টান পড়েনি, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সব তাবড়-তাবড়, শুধু নেই বাজেট। একটা সময় ছিল যখন ভাষাটা বাধা হয়ে দাঁড়াত, এখন তা নয়। এখন হিন্দি মানে অন্য একটা ভাষার ছবি নয়। বাংলা হিন্দিকে অনেক বড় বাজার করে দিয়েছে। হিন্দি ছবি দেখা মানে এখন আর আমাদের মনে হয় না অন্য ভাষায় ছবি দেখছি।
আগের বাংলা ছবির টাইটেল লক্ষ্য করলে দেখবেন, বম্বের কেউ অভিনয় করলে তাঁর নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকত ‘বম্বে’। যেমন: হেলেন (বম্বে), লেখা থাকত ‘মোতি, একটি কুকুর’; তারও নামের পাশে লেখা থাকত ‘বম্বে’। ‘বম্বে’র প্রতি সেই যে আকর্ষণ, সেটা এখন আর নেই। কারণ ভাষাটা সড়গড় হয়ে ওঠার পর থেকে তা অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে আমাদের কাছে। এটা যদি দক্ষিণ ভারতের ছবি হত, তখন আমাদের ডাবিং লাগত। সেখানেও আমরা দক্ষিণী ভাষা থেকে হিন্দি ডাবিংয়ের ছবিকেই গ্রহণ করেছি আগে… ‘পুষ্পা’, ‘আরআরআর’। আগে হিন্দি স্টারেরা ছিলেন আত্মীয়ের মতো, কুটুমের মতো। এখন তাঁরাও আমাদের দর্শকদের কাছে ঘরের স্টার। সেটাই তো ছবির সংজ্ঞা হওয়া উচিত।
ভাল গল্প, ভাল অভিনেতা কেন বঞ্চিত হবেন। বাংলার দর্শকদের স্বাদ বরাবরই খুব উচ্চমাণের। বুদ্ধিদীপ্ততাকেই তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন বারবার। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ফলে এখানে অজয় দেবগণের মুখে হিন্দিটাই তাঁদের শুনতে ভাল লাগে। মোটেও তিনি বাংলা বললে অথবা তাঁর বলা হিন্দি সংলাপ বাংলায় ডাব করা হলে সুখকর হবে বলে আমার মনে হয় না। তাই কেন বাংলায় হচ্ছে না, বাণিজ্যিক দিক থেকে এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থহীন। আর আবেগের ক্ষেত্রে যদি সেই প্রশ্ন ওঠে, তবে নিঃসন্দেহে বলব, বাঙালিরা হিন্দিকে যেভাবে গ্রহণ করেছে, সেটা প্রশংসনীয়। যার ফলে আমরা হিন্দিতে কাজ করলেও তা বাঙালিরা গর্বের সঙ্গে বলেন, দেখেন, প্রশংসা করেন। বাংলা ভাষায় ‘ময়দান’ বাঙালিদের একটা আবদার বা দাবি হতে পারে। ভাষাজনিত সমস্যা হতে পারে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।