ঈশ্বর আমাদের স্মৃতি দিয়েছেন। তাতে বৈশাখের খরতাপেও কাশফুল ফুটে ওঠে। আমাদের গ্রামপথে, আমাদের ডোবায়, আমাদের আগাছায়, যখন অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি পড়ে, আমরা সবিস্ময়ে জেগে উঠে দেখি আমাদের নব মেঘদূত রচিত হয়ে চলেছে, মন্দাক্রান্তায় নয়, বাঙালির প্রাণের পয়ার ছন্দে। মেঘমাসক্লিষ্ট দিগন্তরেখা, প্রায় প্রাকৃতিক আলো, কাশফুলের অগোছালো গৌরবে হাওয়া বয়ে যায়, যেন ধরিত্রীর স্তন-শিহরণ! ‘পল্লব অঞ্জন চোখে, মুক্তাবিন্দু খল শোকে’—নব ‘গোলেবকাওয়ালী’ ও নির্বোধের বিনোদনে প্রস্তরীভূতা আমাদের চলচ্ছবি প্রতিমাটি তো জীর্ণ একটি মিশেল ক্যামেরার স্পর্শেই শাপমুক্ত হল।
সত্যজিৎ রায়কে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? আজ শতবর্ষের মুহূর্তে তাঁকে আমরা প্রণাম জানানোর সময় মনেই রাখি না তিনি এমন একটি ইতিহাস-বিন্দু যেখান থেকে আমাদের চলচ্চিত্র ভাষার আধুনিকতা শুরু হল। যাঁরা চলচ্চিত্র ভাষার কথা বলেন, সিনেমার ভাষার কথা বলেন ভারতবর্ষে বা বাংলায় তাঁরা সাধারণত এ কথা বলেন না যে লিখিত ভাষার সঙ্গে চলমান চিত্রভাষার পার্থক্য আছে। লিখিত ভাষার একটা ব্যাকরণ আছে প্রায় হাজার বছরের পুরনো। তার সংস্কার সাধন বা উন্নয়ন হয়তো লেখকের কাজ। কিন্তু লেখকের পক্ষে একটি সাংস্কৃতিক অভিধান আছে। অন্য দিকে, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই সাংস্কৃতিক অভিধান নেই। আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করলে বলা যায় যে চলচ্চিত্র ভাষা অনেকটাই ইনভেন্টেড ফ্রেন্ডলি, ইউজার ফ্রেন্ডলি। অর্থাৎ কোন জানালার পর কোন জানালা খুলব, সেটা কিন্তু পরিচালকের উপরেই অনেকটা নির্ভর করে। এখন এই যে পরিচালকের উপর নির্ভর করে এ কথাটা আমাদের সিনেমায় মস্ত বিপ্লব এনে দিল কারণ এমন নয় যে আমাদের কাহিনী বর্ণনার ঐতিহ্য ছিল না ছায়াছবিতে—ছিল।
বিখ্যাত ‘নিউ থিয়েটারস’—৩০-এর দশক থেকেই যখন শব্দ সংযোজন হল ভারতীয় ছবিতে— তখন সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেছে… আমরা তুলনা বিরহিত সংলাপ এবং কাহিনীকে দৃশ্যে এবং ধ্বনিতে রূপায়িত হতে দেখে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। সত্যজিৎ রায় তাহলে ১৯৫৫তে নতুন কী করলেন? এ কথা বলার তো প্রয়োজন হয় না বেশি। তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ থেকে ‘পথের পাঁচালি’ চিত্রনাট্য বানিয়েছিলেন। একটি কথা খুব জরুরি, আমরা গল্প উপন্যাস থেকে ছবি অনেকবার বানিয়েছি এবং সেই বানানোতে আমাদের অধিকার বা দক্ষতা এত প্রমাণিত ছিল যে আমাদের এখানে সিনেমাকে ‘বই’ বলাও চালু হয়ে গিয়েছিল।
সত্যজিৎ কী করলেন? তিনি বরং এমন এক ভাষার উদ্ভাবন ঘটালেন যে ভাষাতে শব্দ কম, সংলাপ কম, দৃশ্যের আর কোনও কাচ লাগে না। দৃশ্য নিজেই তার পদশব্দে চমৎকৃত হতে পারে, আমরা আড়াল থেকে সেই মুগ্ধতার অংশীদার হতে পারি। ‘পথের পাঁচালি’ যদি কেউ চোখ বুঝে দেখেন, তা হলে দেখবেন, বাংলা সিনেমার বিপরীতে বা ভারতীয় সিনেমার বিপরীতে এই ছবিতে কথা কত কম এবং সত্যজিৎ রায় যখন রাজাধিরাজ—অর্থাৎ বিখ্যাত ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যে পর্ব—পথের পাঁচালি থেকে চারুলতা, তখনও পর্যন্ত সত্যজিৎ কত কম কথা বলেছেন। তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন যেটা তাঁরই কথা, “cinema is to narrate with images not ideas”। অর্থাৎ আপনি কী বলছেন ধারণা বা গল্পটা বড় কথা নয়, কী ইমেজ দিয়ে বলছেন সেটাই আসল। এই যে ইমেজগুলো বলা, এই যে আমরা কাশবনে দেখলাম সাদা-কালোর বিপুল অভ্যুত্থান এবং আমরা প্রথম জানলাম সাদা রং শুধু সাদা নয় এবং কালো রং শুধু কালো নয় তারও স্বরলিপি থাকে… অর্থাৎ সাদার থেকে কালোর উত্তরণের নানারকম স্তর, স্বর, প্রতিস্বর থাকে। এই যে আমরা জানলাম আলো আর ছায়া ঈশ্বরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে পারে এ তো ‘পথের পাঁচালি’র মূল অবদান।
আমাদের মধ্যে এখনও অনেকেই মনে করেন, কী চমৎকার তিনি রূপায়িত করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’কে…ভুল। বিভূতিভূষণের লেখার তিনি এক তৃতীয়াংশও নেননি। এমনকী ইন্দিরা ঠাকুরণের অংশটি এ তো প্রথম সতেরো পাতার মধ্যে শেষ হয়ে বিভূতিভূষণের উপন্যাসে। কারণ বিভূতিভূষণ সেই দুর্ভাগ্যকে নিয়ে বেশি দূর এগোননি। সত্যজিৎ রায় মনে করেছিলেন চুনিবালাকে নিয়ে তিনি অনেক দূর কাজ করবেন এবং তিনি করেওছেন। চুনিবালা হয়ে উঠেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, ‘বাংলার প্রাণের প্রতিমা’। তাঁর তাকানো, তাঁর নিঃশব্দ পদপাদ, তাঁর এরকম এক মৃত্যু এইরকম আমরা দেখিইনি। এই যে আমরা দেখি কোনও কিছু লুকিয়ে পড়ল পানাপুকুরে, এই যে আমরা দেখি একট বালিকা বৃষ্টিতে ভিজছে এবং সেই বালিকাটির কোরিওগ্রাফ এমনই যে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের স্মৃতির অতল থেকে মনে হয় তাহলে কি একদিন পার্বতী এভাবেই মহেশ্বরকে আহ্বান করেছিল? মনে রাখবেন সত্যজিতের বৃষ্টি হয়েছে গরমকালে আর বিভূতিভূষণের বৃষ্টি হয়েছিল শরৎকালে। শরৎকালের বৃষ্টির সঙ্গে দুর্গার চলে যাওয়া আর এই যে দুর্গার নাচের ছন্দে চলে যাওয়া এটা ভারতবাসীর গহনে যায় এবং স্মৃতির অজস্র অন্ধকার থেকে ভেসে আসে নতুন প্রতিমা। এই যে চারুলতার একটা শূন্য অন্দর মহলের অলিন্দে এক নারীবাহুর সৌন্দর্য, এই যে আমরা দেখি গ্রাফিতি পাল্টে যাচ্ছে সত্তর দশকে, দেওয়াল লেখাগুলো পাল্টে যাচ্ছে, এই যে আমরা দেখি ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাক দেওয়া…’ গানটা কি অপ্রয়োজনীয়? কেউ অবান্তর হয়ে উঠছে অথচ সত্যজিৎ রায় তাঁকে প্রয়োগ করছেন আমাদের নরকযাত্রার পথে। আমরা থরে থরে সৌন্দর্য্যকে তাঁর সঙ্গে সহবাস করতে দেখি। তিনি আমাদের সৌন্দর্য্যের শিক্ষা দিয়েছেন।
এমনকী যখন আমরা দেখি ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে কোম্পানি ফৌজ এগিয়ে যাচ্ছে লখনউয়ের দিকে, আমাদের অহঙ্কার শেষ হল… তখন সত্যজিৎ কোনও পক্ষপাত নিতে পারেন না। তিনি না পারেন অবসিত গরিমা ফিউডালতন্ত্রকে সমর্থন করতে, না পারেন আগ্রাসী ইংরেজবাদকে সমর্থন করতে। কিন্তু তিনি ইতিহাসের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকেন একটি বালকের মতো। এই যে বালকটি যে সীমানার বাইরে থেকে দেখে, কেবলই দেখে চলে অনেক সুদূরকে কিংবা খুব কাছে অন্দরমহলকে, সেই দেখাটা আমাদেরকে কত বড় দেখা এই শতবর্ষে এসে আমাদের উপলব্ধি হল। অপু ভাগ্যিস দেখেছিল, একটা পরিবারের বাইরে থেকে… কারণ তাঁর কাছে তো জীবন-মৃত্যু সমান কারণ সে শিশ, পিকু ভাগ্যিস দেখেছিল, সে আমাদের নির্জ্ঞান যৌনতার সঙ্কট দেখতে পায় কারণ সে তো বাইরের লোক, সে শিশু, এই যে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে আর একটি শিশু দেখে, দেখে ভারতীয় ইতিহাসের বিপর্যয় এই দেখাটা সত্যজিৎ অর্জন করেছিলেন অনেক রণ-রক্তকোলাহলের মধ্য থেকে এক ধরনের নিরাসক্ত ভঙ্গিমায়। উপেন্দ্রকিশোরের পৌত্র সুকুমার রায়-তনয় হিসেবে তিনি অর্জন করেছিলেন। আজ তাঁর শতবর্ষ। ভারতবর্ষ তাঁর কাছে গল্প বলা শিখবে না বরং শিখবে কী করে একটা তুচ্ছতাও বাঙ্ময় হতে পারে। এ দেশ চিরকাল বিশ্বাসকরেছে সর্বাস্তিবাদে। একটা পাথরে টুকরো, একটা গাছের পাতা, একটা ধানের ক্ষেত, একটা নদীর জল, একটি নারীর কপালের টিপ, একট যুবকের ক্রোধ… সমস্ত বিষয় হয়ে যায় যদি বলতে পারা যায়। যিনি পারেন তিনি পারেন। সত্যজিৎ ভাষার অতিরিক্ত ভাবে কথা বলতেন বলেই আমরা ভাষা পেলাম। এই ভাষার জনপ্রিয়তাকে যেন আমরা প্রণাম নিবেদনের যোগ্য হয়ে উঠি।
অলঙ্করণ- অভীক দেবনাথ