
তিনি সত্যজিৎ রায়। তিনি গল্প, উপন্যাস লিখতেন, ছবিও আঁকতেন। সিনেমা তৈরির করে গোটা বিশ্বকে চমকেও দিয়েছিলেন। সেই সত্যজিতের ছোটবেলা কেটেছিল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে। কবি গুরুর ছত্রছাত্রায় থেকেই ব্রাহ্ম হয়েছিলেন সত্য়জিৎ। বাঙালির আইকন, বিশ্ববিখ্য়াত পরিচালক। সর্বপরী এক মহানশিল্পী। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পীদের কোনও নির্দিষ্ট কোন ধর্মে বাঁধা যায় না। তাঁদের কাজ, তাঁদের আর্ট অ্য়ান্ড ওয়ার্কই আসল ধর্ম, আসল পরিচয়। কিন্তু ধর্মীয় সংকীর্ণ মানুষের কটাক্ষের হাত থেকে সত্যজিৎও বাঁচতে পারেননি। ফেলুদার শ্রষ্ঠাকেও সহ্য করতে হয়েছিল ধর্মীয় খোঁচা। আর এসবই হয়েছিল তাঁর পরিচালিত জনপ্রিয় ছবি ‘দেবী’ মুক্তি পাওয়ার পর।
সময়টা ১৯৬০ সাল। মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের বহুল চর্চিত ছবি দেবী। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প দেবী অবলম্বনেই ছবিটি তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৮৯৯ সালে। দেবী গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতা। কিন্তু সত্যজিৎ রায় সিনেমার পর্দায় দেবীকে রূপ দিলেন আরও আধুনিক পর্যায়ে গিয়ে। এই ছবির মূল তিনটি চরিত্র, জমিদার কালীকিঙ্কর অর্থাৎ ছবি বিশ্বাস, দয়াময়ী ওরফে শর্মিলা ঠাকুর এবং অধ্যাপক উমাপ্রসাদ ওরফে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবির গল্পের কেন্দ্রে ছিল দয়াময়ী। এক রাতে স্বপ্নের মধ্যে পুত্রবধূ দয়াময়ীর মধ্যে মাকালীর অবতার দেখতে পান কালীকিঙ্কর। এই স্বপ্নকে ঈশ্বরের ইঙ্গিত বা বার্তা ভেবে দয়াময়ীর উপর দেবত্ব আরোপ করে তাঁর আরাধনা করতে শুরু করেন।
প্রথমে শ্বশুড়ের এমন কাণ্ডকারখানায় কিছুটা হতবাক হলেও, কোনও প্রতিবাদ না করেই অংশ নিতে থাকত দয়াময়ী। কিন্তু একসময় নিজেকে পরিস্থিতিকে বাঁচাতে কলকাতায় চাকরিরত স্বামী উমাপ্রসদাকে চিঠি লিখে দ্রুত আসতে বলে। সত্যজিৎ দয়াময়ী চরিত্রকে মাঝখানে রেখে কালীকিঙ্করকে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং উমাপ্রসাদকে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চরিত্র হিসেবে তুল্যমূল্য করেন। চিত্রসমালোচকরা মনে করেন, দেবী ছবির একেবারে শেষদৃশ্যে সত্যজিৎ যেন পরিষ্কার করে দেন তাঁর অবস্থান। দর্শকের সামনে কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং তাঁর বিপরীত ছবি তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ। চিত্রসমালোচকরা মনে করেন, দেবীর শেষটা আসলে ওপেন এন্ডেড। এখানে কুয়াশা আসলে কুসংস্কারের রূপক, যার মধ্যে দিয়ে দয়াময়ী (শর্মিলা ঠাকুর) হারিয়ে যাচ্ছেন, যা জীবনের ট্র্যাজেডিকেই উপস্থাপন করে।
তবে দেবী ছবি সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সত্যজিৎ। জানা যায়, সেই সময় চিত্র সমালোচক, দর্শকের একাংশ সত্যজিতের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন এই ছবি হিন্দু ধর্ম, হিন্দু ধর্মের রীতিনীতিকে অসম্মান করে। এমনকী, সত্যজিৎকে শুনতে হয়েছিল কটাক্ষ। অনেকেই বলেছিলেন ‘তিনি হিন্দু নন, ব্রাহ্ম বলেই এমন ছবি তৈরি করেছেন!’
এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ জানিয়ে ছিলেন, তাঁর দেবী ছবি ধর্মীয় ডগমাটিজমকে আক্রমণ করে। কখনই ধর্মকে আক্রমণ করে না। তবে মানুষ পুরোটাই ভুল বুঝেছিল, অনেকেই বলেছিল সত্য়জিৎ রায় হিন্দু নয়, ব্রাহ্ম বলেই এমন ছবি তৈরি করেছেন এবং হিন্দুধর্মকে অসম্মান করেছেন। সত্যজিৎ এই সাক্ষাৎকারে এমনটাও জানান, এই ধরনের সংকীর্ণতাকে কখনই গুরুত্ব দেওয়া যায় না। যাঁরা এসব বলছে তাঁরা স্টুপিড।