গয়ায় সুচিত্রা স্বামীর পিণ্ডদানের পর পুরোহিতকে কী বলেছিলেন?

তখন সুচিত্রা আলো আমার আলো ছবির শুটিং করছেন। সঙ্গে নায়ক উত্তম কুমার। হঠাৎই ইন্ডাস্ট্রি নানাবিধ কারণে ধর্মঘট শুরু হল। একে একে বন্ধ হতে থাকল ছবির শুটিং।

গয়ায় সুচিত্রা স্বামীর পিণ্ডদানের পর পুরোহিতকে কী বলেছিলেন?

|

Jul 15, 2025 | 2:31 PM

তিনি মহানায়িকা।  শুটিং ফ্লোরে তাঁর দাপট ছিল। শুটিংয়ে লোকজনের সঙ্গে নাকি খুব একটা কথাও বলতেন না। নিজের মতো ক্য়ামেরার সামনে শট দিতেন, আর চেয়ারে বসে বই পড়তেন। দম্ভ নাকি তাঁর মুখশ্রী চুঁইয়ে পড়ত। তবে গসিপ ম্য়াগাজিনে এসব রটলেও, আসলে সুচিত্রা মোটেই এমন ছিলেন না। অন্তত, তাঁর সহঅভিনেতা ও সহঅভিনেত্রীদের সাক্ষাৎকারে তেমনটাই উঠে আসে। তবে তিনি মারাত্মক প্রফেশনাল ছিলেন, সেটা কিন্তু নানা ঘটনাতেই প্রমাণিত। এই যেমন, এক সিনেমার শুটিংয়েই সুচিত্রা পেয়েছিলেন, তাঁর স্বামী দিবানাথ সেনের মৃত্যু হয়েছে। সুচিত্রা কিন্তু খবর পেয়ে শুটিং থামাননি। বরং শুটিং শেষ করেই পৌঁছেছিলেন স্বামীকে শেষ বিদায় দিতে।

তবে এই গল্প, সুচিত্রার মুক্তি ও শান্তির সন্ধানের। তিনি মহানায়িকা। সাফল্য তাঁর পদচুম্বন করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি দূর থেকে দেখা এক উজ্জ্বল তারকা। কিন্তু সব পেয়েও, সুচিত্রা বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন বিচলিত। তাঁর ঘনিষ্ঠরাও টের পেতেন, সুচিত্রার সেই অস্থিরতার কথা। কিন্তু মহানায়িকা কখনও কাউকে পেতে দেননি মনের খবর।

ঠিক যেমন কখনও কাউকে টের পেতে দেননি তাঁর দাম্পত্যে কী কী ঘটছিল। জানা যায়, পুরীতে ঘুরতে গিয়ে স্বামী দিবানাথ সেনের মা সুচিত্রাকে একেবার দেখেই পছন্দ করে নেন। তারপর চটজলদি বিয়ে। সুচিত্রার তখন বয়স খুবই অল্প। মা-বাবার পছন্দকেই হ্য়াঁ, বলতে বাধ্য হয়েছিলে তিনি। তারপর কলকাতায় এসে দিবানাথের সঙ্গে সংসার জীবন শুরু তাঁর। এই দিবানাথ সেনের জন্যই অভিনয়ে এসেছিলেন সুচিত্রা। স্বামী দিবানাথের হাত ধরেই প্রথম স্টুডিওপাড়ায় পা দিয়েছিলেন তিনি। স্বামী দিবানাথের নানা পরামর্শেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন মহানায়িকা।

গুঞ্জনে রয়েছে, তবে পরের দিকে সুচিত্রার এই অভিনয়ই, তাঁর দাম্পত্যের কাঁটা হয়ে ওঠে। এমনও শোনা যায়, উত্তম ও সুচিত্রাকে নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে যে রটনা ছিল, তা মোটেই পছন্দ করতেন না দিবানাথ। ফলে অভিমান, রাগ জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছিল সুচিত্রা ও দিবানাথের মাঝে। ফলাফল দাম্পত্যে চরম অশান্তি। শোনা যায়, মহানায়িকার বহুদিন কেটেছে মদ্যপ স্বামীর কাছে কুকথা শুনে। কিন্তু সুচিত্রা সেন চুপ করে থেকে ছিলেন। সেই অশান্তির আঁচ পড়তে দেননি তাঁর অভিনয় জীবনে এমনকী, দুই মেয়ের ওপরও। তাই একটা সময়ের পর মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে স্বামীর বাড়িও ছেড়েছিলেন। কিন্তু কখনও বাইরের মানুষদের বুঝতে দেননি তাঁর জীবনের ঝড়কে। বরং ব্যক্তিগত জীবনকে মেকআপের আড়ালে লুকিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনুরাগীদের স্বপ্নসুন্দরী।

১৯৬৯ সালে পরিচালক সুশীল মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘ কালো’ ছবির শুটিং করছিলেন সুচিত্রা সেন। তখনই খবর আসে, সুচিত্রার স্বামী আর নেই। জাহাজে ট্র্যাভেল করার সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুচিত্রার স্বামী দিবানাথ। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন সুচিত্রা। শুধু বলেছিলেন, ”আমার জীবনের একটা চাবি হারিয়ে গেল।” তবে স্বামীকে হারিয়ে মারাত্মক শোকগ্রস্ত হলেও, বুকে কষ্ট নিয়েই ‘মেঘ কালোর’ শুটিং শেষ করেছিলেন সুচিত্রা। মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটা ইচ্ছা। যা কিনা পূরণ করতেই হত সুচিত্রাকে।

সময়টা সত্তর দশকের একেবারে গোড়ার দিক। তখন সুচিত্রা ‘আলো আমার আলো’ ছবির শুটিং করছেন। সঙ্গে নায়ক উত্তম কুমার। হঠাৎই ইন্ডাস্ট্রিতে নানাবিধ কারণে ধর্মঘট শুরু হল। একে একে বন্ধ হতে থাকল ছবির শুটিং। ঠিক তখনই পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বেনারসে রওনা দিলেন সুচিত্রা। পিনাকীকে সুচিত্রা জানিয়ে ছিলেন তিনি স্বামী দিবানাথের পিণ্ডদান করতে চান। সেই কারণেই পিনাকীকে সঙ্গে নিয়ে বেনারস থেকে গয়া গিয়েছিলেন মহানায়িকা।

জানা যায়, গয়ায় সুচিত্রা সব আচার অনুষ্ঠান মেনে পিণ্ডদান সম্পন্ন করেন। ততদিনে বলিউডে ‘মমতা’ ছবি মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। ফল্গু নদীর তীরে হাজার মানুষের ভিড়ে সুচিত্রা যখন পুরোহিতের সঙ্গে স্বামীর পিণ্ডদান করছেন, তখন অনেকে তাঁকে দেখলেও, বিশ্বাস করতে পারেননি এটাই সেই সিনেপর্দার অভিনেত্রী। সেদিন পিণ্ডদনের পর পুরোহিতকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন মহানায়িকা। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সত্য়িই কি এখানে আসলে মুক্তি পাওয়া যায়? সুচিত্রার প্রশ্নে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন পুরোহিত। এমনকী, সেই প্রশ্নে ঠিক মতো উত্তর দিতে পারেননি পুরোহিত। আসলে কথিত রয়েছে, গয়ার বিষ্ণুপদ মন্দিরে ভগবান বিষ্ণুর পদচিহ্ন রয়েছে। এখানে পিণ্ডদান করলে আত্মার মোক্ষ লাভ হয়। হয়তো সুচিত্রা পুরোহিতের কাছে সেই কথাই যাচাই করে নিচ্ছিলেন! কিন্তু সদুত্তর তিনি পাননি। আর তাই তো  এরপর গয়া থেকে সোজা বেনারসে চলে আসেন মহানায়িকা। খবর পান ধর্মঘট উঠেছে, ফের ছবির শুটিং শুরু হবে। কিন্তু সুচিত্রা কলকাতা ফিরলেন না। পরিচালককে অনুরোধ করলেন, তাঁকে দুদিন একা ছেড়ে দিতে। তিনি কিছুটা সময় বেনারসেই থাকতে চান। সেদিন সুচিত্রার অনুরোধ শুনেছিলেন পরিচালক পিনাকী। দুদিন বেনারসে কাটিয়েই কলকাতায় ফিরে ফের ‘আলো আমার আলো’ ছবির শুটিং করেছিলেন মহানায়িকা।

তবে কে জানত, এই স্বপ্নসুন্দরীর মন অশান্ত! নাম, যশ, প্রতিপত্তি থাকলেও, শান্তি ছিল না! কী কারণে সুচিত্রা সেন, বেনারসের গঙ্গার ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন গঙ্গার দিকে তাকিয়ে? সে উত্তর আজও অধরা।