মৃত্যুদিনে উত্তমের বাড়ির অন্দরে কেমন ছিল চিত্র? সবটা জানল TV9 বাংলা ডিজিটাল

Sneha Sengupta |

Jul 24, 2024 | 3:21 PM

Uttam Kumar Death: আজই সেই দিন। আজ ২৪ জুলাই। ৪৪ বছর আগে, আজকের দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। সেই দিনটার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে ভাইঝি ঝিমলির (মনামী বন্দ্যোপাধ্যায়) স্মৃতিতে। তিনি মহানায়কের ছোট ভাই অভিনেতা তরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কাঁপে তাঁর।

মৃত্যুদিনে উত্তমের বাড়ির অন্দরে কেমন ছিল চিত্র? সবটা জানল TV9 বাংলা ডিজিটাল
মৃত্যুদিনে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়।

Follow Us

 

স্নেহা সেনগুপ্ত

কাজ করতে-করতেই চলে যেতে চেয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়। বিধাতারও তাই অভিপ্রায় ছিল। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে রেজ়ার হাতে ছবির শেষ শট দিয়েছিলেন মহানায়ক। গাল ভর্তি ফেনা, বুকের তোয়ালেটা এক হাতে চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন। সে সময় বুকে খুবই ব্যথা করছিল উত্তমের। পরিচালক সলিল দত্ত তাঁকে বারবার বলছিলেন বিশ্রাম নিতে। কিন্তু নাছোড় বান্দা উত্তম বলেছিলেন, “আজকে শট নিয়ে নাও সলিল। কাল আমি নাও থাকতে পারি।” মহানায়কের মুখের সেই কথাই অক্ষরে-অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। পরদিন সত্যিই রইলেন না তিনি।

আজই সেই দিন। আজ ২৪ জুলাই। ৪৪ বছর আগে, আজকের দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। সেই দিনটার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে ভাইঝি ঝিমলির (মনামী বন্দ্যোপাধ্যায়) স্মৃতিতে। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কাঁপে তাঁর।

সেই সময় ভবানীপুরের বাড়িতে থাকতেন না মহানায়ক। তাঁর ঠিকানা তখন ময়রা স্ট্রিট। অভিনেত্রী সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে তাঁর আলাদা সংসার। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র সেট থেকে অসুস্থ উত্তমকে কলকাতার এক বেসরকারী হাসপাতালে (বেলভিউ) ভর্তি করেছিলেন গৃহচিকিৎসক সুনীল সেন। ঝিমলিদেবী বলেন, “জ্যাজানের (উত্তমকুমারকে ওই নামেই তিনি ডাকেন) নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে তখন। ডঃ সুনীল সেন তাঁকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বেলভিউতে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জ্যাজান আর থাকবেন না। তাই আমার ঠাকুমাকে বলেছিলেন একবারটি গিয়ে দেখে আসতে।”

ছেলের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে চপলাদেবী (চপলা চট্টোপাধ্যায় – উত্তমকুমারের মা) ছুট্টে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। গিয়ে দেখেন পেট ফুলে আছে ছেলের। নাকের কাছে জমাট বেঁধে আছে রক্ত। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। হাসপাতাল থেকে ছেলেকে ওভাবে দেখে বাড়িতে পা রেখেই চপলাদেবী সোজা চলে গিয়েছিলেন ঠাকুরঘরে। সবকিছুর বিনিময়ে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা করতে নতজানু হয়েছিলেন ঈশ্বরের সামনে। বিকেলবেলায় হাসপাতালে একে-একে গেলেন বাড়ির বাকিরা। সে সময় ‘নহবৎ’ নাটকে তুমুল ব্যস্ত উত্তমের ছোটভাই ‘বুড়ো’ (তরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়)। দাদাকে ওভাবে দেখে তিনিও দ্বিধাগ্রস্ত। ভেবেই পাচ্ছিলেন না শো করতে যাবেন কি না। নাকে-মুখে নল নিয়ে মৃত্যু পথযাত্রী মহানায়ক ছোটভাইকে বলেছিলেন, “কাজ শো কামাই করবি না কোনও কারণেই। কত লোক বসে আছেন তোর অভিনয় দেখার জন্য। সবাই টিকিট কেটে এসেছেন। তুই যা। ৮টায় সিন শেষ হলেই চলে আসবি।” তারপর ০৮.১০শে সিন শেষ হয়। হাসপাতালে গিয়ে বুড়ো দেখেন উত্তমকুমারের কৃত্রিম হার্ট পাম্প হচ্ছে। তারপরই সব শেষ।

স্মৃতির স্মরণী দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে মনামীদেবী বলেন, “কথাগুলো বলতে-বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার মা (অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়) দোতলার ঘরে ছিলেন। নীচের ঘরে চিত্রহার চলছে। ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে আমার কানে। শো শেষ হল আর তখনই ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠল। রিসিভার তোলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুনতে পেলাম মায়ের আর্তনাদ–নাআআআআআআআআআ।”

মনামীদেবী চোখের সামনে ফিরে-ফিরে আসে সব স্মৃতি। বলেন, “ছোট-বউমার আর্তনাদ শুনে আমার ঠাকুমাও বিচলিত। তিনি তখনও কানে অল্প বিস্তর শুনতে পান। ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলতে-বলতে ছুট্টে গেল বাড়ির কাজের মেয়ে। জ্যাজান আর নেই। মা বললেন, ঠাকুমাকে যেন কিছুই না জানানো হয়। আমরা সবাই চুপ। যে যার ঘরে গুমরে কাঁদছি।”

মহানায়কের সঙ্কটজনক অবস্থার খবর পেয়ে আগেই হাসপাতালে ছুট্টে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী গৌরীদেবী। দাঁড়িয়েছিলেন বিরাট একটি নারায়ণের মূর্তির সামনে। ছেলে গৌতম এবং দেওর তরুণকুমার আগেই হাজির হয়েছিলেন। গৌরীদেবীরই পৌঁছতে যা দেরি হয়েছিল সেদিন। বুকে আশা নিয়ে মানুষটার আরোগ্য কামনা করছিলেন বারেবারে। কিন্তু ওই যে! সত্য বড় নিষ্ঠুর। হাসপাতালে পা রাখতেই জানলেন বিধাতা তাঁর কপালে চরম সর্বনাশই লিখে রেখেছেন। দেখলেন, মহানায়কের নশ্বর দেহ নিয়ে নীচে নেমে আসছেন দেওর ও পুত্র।

মৃত দাদার দেহ কাঁধে করে বাড়ির পথে তরুণকুমার। একদিকে দাদার মৃত্যুশোক, অন্যদিকে মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এক মাকে জানাতে হবে তাঁর পুত্রের মৃত্যু সংবাদ। বাড়ি ঢুকতেই কন্যা মনামীকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “ঠাম্মা জানে? জানাতে হবে তো…।” মনামীদেবী বলেন, “সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম সত্যি হল ‘সত্য’। ছেলের মৃত্যু সংবাদ নাকি জানাতে হবে তাঁর মাকে। ঠাকুমাকে সেই নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড় করানো হল। তিনি মুর্ছা গেলেন সঙ্গে-সঙ্গে। জ্ঞান আসছে আর যাচ্ছে। অভিনেতা এবং অর্থোপেডিক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ঠাকুমাকে ঘুমের ইনফেকশন দিয়ে গেলেন। কিন্তু কীসের কী! এই শোক কী ইনজেকশনে মেটে!”

বক্ষফাটা বেদনায় ছিন্নভিন্ন হতে-হতে এক সাধুবাবার কথা বারবার আওড়েছিলেন মহানায়কের মা চপলাদেবী। তাঁর বাবার এক বন্ধু সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। মহানায়কের জন্মের পর তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। সদ্যজাত অরুণকে (উত্তমকুমারের পিতৃদত্ত নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) দেখে তিনি চপলাদেবীকে বলেছিলেন, “ছেলেটার কপালটা দেখেছিস চোপু। ওর জগৎ জোড়া নাম হবে। তুই ওকে ধরে রাখতে পারবি না।” মহানায়কের মৃত্যুর খবর পেয়ে বারবার আওড়াচ্ছিলেন চপলাদেবী, “আমার নাড়িটা দলা পাকিয়ে মুখে দিয়ে বেরিয়ে আসছে…”

Next Article