রবি ঘোষ ও রুদ্রনীল ঘোষ। দুই বাঙালি অভিনেতা। একজন সিনিয়র দিকপাল। অন্যজন বর্তমান। একটা সময় ছিল রুদ্রনীলকে রবি ঘোষের পুত্র ভেবে ভুল করেছিলেন অনেকেই। তাঁর অভিনয় দেখে প্রশংসা করেছিলেন খোদ রবি ঘোষের স্ত্রী। বিষয়টি রুদ্রনীলের কাছে যতখানি আনন্দের, ততখানিই লজ্জার। আজ (২৪.১১.২০২১) রবি ঘোষের জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে নিজের ‘অভিনয়ের বিশ্ববিদ্যালয়’ রবি ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন রুদ্রনীল ঘোষ। TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দিকপাল শিল্পীদের কাজের সংরক্ষণ না হওয়ায় দুঃখও প্রকাশ করলেন তিনি।
প্রশ্ন: একটা সময় অনেকেই মনে করতেন রুদ্রনীল ঘোষ বোধহয় রবি ঘোষের পুত্র। বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর: এটা অনেকেই ভাবতেন। এখনও শুনলে প্রথমে মজা পাই, তারপর লজ্জা পাই। আমার বাবার নাম রবীন ঘোষ। দেখতে গেলে, রবি আর রবীনে কেবলই ‘ন’-এ তফাৎ। আমার বাবার ছোটখাটো চেহারা। রবিবাবুরও তাই। আমারও ছোটখাটো চেহারা। মনে করি কিংবদন্তিদের রেখে যাওয়া কাজগুলোই আমাদের কাছে শিক্ষা। এইরকমই সূক্ষ্ম অভিনয়ের ক্ষেত্রে রবিবাবু ইনস্টিটিউশন। আমি কেন, অনেকে সেটাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, “রবি ঘোষ যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করতে তা হলে তাঁর নামে অভিনয়ের ইউনিভার্সিটি খোলা হত।”
ফলত, এরকম একটা মানুষের কাজ দেখে শিখে, সেগুলো ঠিক জায়গায় ব্যবহার করার চেষ্টা আমি ও আমার মতো অনেকেই করেন। আমাদের চেহারার সাদৃশ্য, পদবিতে মিল, নামের প্রথম অক্ষরে মিল দেখে কেউ কেউ ভেবে নিয়েছিলেন, আমার আর রবিবাবুর বোধহয় পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। এসব শুনে খুব লজ্জা পাই জানেন। তিনি যে মানের অভিনেতা, তার কণামাত্রও তো হতে পারব না কোনওদিন। আমি নিজেও চাই বর্তমান প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্ম রবিবাবুর মতো দিকপালদের রেখে যাওয়া কাজগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হোক।
প্রশ্ন: মৃণাল সেনের মতো দিকপালের কাজের সংরক্ষণ ও আর্কাইভের কাজ করছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা নয়। অন্যান্য দিকপালদেরও সেরকম আর্কাইভ নেই কলকাতা কিংবা ভারতের অন্য কোনও জায়গায়। একজন শিল্পী হিসেবে কষ্ট হয় না?
উত্তর: কষ্ট ও খারাপ লাগা দুটোই আছে। জনজাতি বেঁচে থাকে তাঁর ভাল কাজের মধ্যে দিয়ে। আর বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে অতীতের উপর ভিত্তি করে। দিকপালদের কাজের সংরক্ষণ করা উচিত সাধারণ মানুষের জন্য। শিল্প ও সংস্কৃতির ইতিহাসকে সম্মানিত করার জন্য দেশ ও রাষ্ট্রের কাছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে জড়তা কাটিয়ে সরকারের তৎপর হওয়া উচিত। আমার অনুরোধ রইল, এটা নিয়ে যেন কেউ ব্যবস্থা নেন।
প্রশ্ন: প্রথমে কে বলেছিলেন, আপনি রবি ঘোষের ছেলে?
উত্তর: ‘এক নম্বর মেসবাড়ি’ নামের একটি জনপ্রিয় সিরিয়ালে অভিনয় করতাম একটা সময়। সেই সময়তেই একজন আমার অভিনয় দেখে এই কথা বলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন রবিবাবুর স্ত্রী নিজে…
প্রশ্ন: তাই বুঝি, এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার…
উত্তর: শুনুন তবে বলি। একদিন নন্দন-এ গিয়েছি। একজন ভদ্রমহিলা হঠাৎ এসে আমাকে বললেন, ‘তোমার অভিনয় দেখি। খুব ভাল লাগে।’ তখনও চিন্তে পারিনি তিনি রবিবাবুর স্ত্রী। আমার এক সিনিয়ার এসে চিনিয়ে দিয়ে যান। আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এর চেয়ে লজ্জার কিছু হয় না।
প্রশ্ন: জ্ঞানত কি কখনও রবি ঘোষের অভিনয়কে অনুকরণ করেছিলেন?
উত্তর: কেবল রবি ঘোষকে নয়। আমি অনুকরণ করেছি অনেককেই। সকলেরই নাম নিতে হয় এখানে। তরুণ কুমার, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বিশ্বাস… আরও অনেকে আছেন। সেটার যদি আর্কাইভ তৈরি না করা হয়, বর্তমান প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই সঙ্গে দেশও।
প্রশ্ন: আপনি তো নিজে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়োপিক ‘অভিযান’-এ রবি ঘোষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন…
উত্তর: এই চরিত্রটা করার সময় দেখলাম রবি ঘোষের ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ খুব কম রয়েছে। দুরদর্শনের কিছু ইন্টারভিউ ছিল। ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন রবি ঘোষ। প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও তিনি বলতেন না। রাশভারী গোছের মানুষ ছিলেন। সেই ইন্টারভিউগুলো ক্রমাগত দেখা ও তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্বভাব আন্দাজ করে অভিনয় করেছিলাম।
প্রশ্ন: রবি ঘোষের করা চরিত্র যদি করতে বলা হয় কোনটা করবেন?
উত্তর: ‘গল্প হলেও সত্যি’। রবি ঘোষের অভিনীত ধনঞ্জয়ের চরিত্রটা আমি করতে চাইব। এর সঙ্গে যেটা প্রয়োজন – অন্যান্য তুখোড় অভিনেতা ও দারুণ চিত্রনাট্য। আমি মনে করি সহ-অভিনেতারা অন্যান্য অভিনেতাদের জ্যান্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করেন।
প্রশ্ন: ‘গল্প হলেও সত্যি’ কি ফের রিক্রিয়েট করার কথা ভাবা হচ্ছে?
উত্তর: হ্যাঁ, সত্যি ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতখানি সম্ভব হবে জানি না।
প্রশ্ন: ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর রিমেক হলে ‘বাঘা’ যদি আপনি হন, ‘গুপী’ কাকে চাইবেন?
উত্তর: লম্বাটে চেহারা, মেদহীন, ছিপছিপে। আমার মনে হয় আবীর চট্টোপাধ্যায় কিংবা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় করতে পারেন চরিত্রটা। অনির্বাণ ভট্টাচার্যও হতে পারেন।
প্রশ্ন: রবি ঘোষের নামটা শুনলে প্রাথমিকভাবে মনে আসে ‘কমেডিয়ান’ শব্দটা। দুর্ভাগ্যবশত রবি ঘোষের মতো এক চরিত্রাভিনেতাকে শুধুমাত্র কমেডিয়ানের খাঁচায় বন্দি করে রাখা টলিউডের কতবড় ব্যর্থতা?
উত্তর: আমার মনে হয় কেবল টলিউড নয়, ভারতীয় সিনেমার ধরনটাই এর জন্য দায়ী। আজ যে আমরা ব্যর্থতা কিংবা সাফল্যের প্রশ্নগুলো তুলতে পারছি, তার কারণ আমরা আধুনিক হয়েছি ও অনেকগুলি বিষয়ে জড়তা কাটিয়েছি। তাই ‘কমেডিয়ান’ বলে শব্দটা যে রবি ঘোষের মতো দিকপাল অভিনেতার উপর চাপিয়ে দেওয়া হত, সেটা কিন্তু আজ কেটে গিয়েছে। পরিবর্তে হয়েছে ‘বেস্ট অ্যাক্টর ইন কমিক রোল’। বলতে পারি, আজকের দিনে জন্মালে রবি ঘোষের মূল্যায়ন আরও বড় মাপের হত।
প্রশ্ন: রবি ঘোষকে এক বাক্যে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর: আন্তর্জাতিকমানের সূক্ষ্ম অভিনয়ের বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন: Rabi Ghosh Birth Anniversary: খেতে খেতে সমানতালে অভিনয় করতে পারতেন রবিকাকা: সন্দীপ রায়