
সুচিত্রা সেন মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন অনেকেই সঠিক জানেন না। কারন একটা সময়ের পর নিজেকে দর্শকদের থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে সেই সময়ের সিনেমার সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীদের থেকে বা সাংবাদিকদের থেকে টুকরো টুকরো গল্প উঠে আসে। কারও কথায় তিনি কিছুটা দাম্ভিক, আবার কারও কথায় তিনি ব্যক্তিত্বময়ী একজন অভিনেত্রী, তবে তিনি তাঁর চারপাশে এমন এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রাখতেন, যাতে তাঁকে বোঝা ছিল মুশকিল। তবে পরিচালক তরুণ মজুমদার, তাঁর ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে ‘ বইতে মিসেস সেনকে নিয়ে এমন এক গল্প বলেছেন, তাতে মহানায়িকার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
তরুণ মজুমদারের ভাষায়, “সেই সময় স্মৃতিটুকু থাক ছবির শুট চলছে। আর সেই শুটেই বিচ্ছিরি কথা কাটাকাটি হয়েছিল সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমার, যে মহিলা আমাকে পরিচালক হয়ে ওঠার জন্য এতো সাহায্য করেছেন ,তাঁর সঙ্গেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা ঠিক যা হয়েছিল, সবিস্তারে না বললে হবে না। একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য শুট হচ্ছিল, শিল্পী বলতে তিন জন,মিসেস সেন, অসিতবরণ আর এক বছর বয়সি একটি শিশু শিল্পী। শিশুটিকে কোলে নিয়ে মিসেস সেনকে অভিনয় করে যেতে হবে, বেশিরভাগ ডায়লগ তাঁর, মাঝে মধ্যে অসিতবরণের সংলাপ। মহড়ার সময় বোঝা গেল বিষয়টা এতো সহজ হচ্ছে না, কারণ মিসেস সেনের কোলের বাচ্চাটি এত আলো লোকজন দেখে ঘাবড়ে গেছে, তাকে সামলে সটিক পরিমিত অভিনয় করা, চোখে জল চিক চিক করবে, তবে জল বাইরে আসবে না। তাহলেই আবার প্রথম থেকে করতে হবে। মিসেস সেন বললেন, তিনি একটু মনিটর দেখে নেবেন, সব ঠিক থাকলে ফাইনাল টেক। কয়েকবার মনিটর করার পর যখন মনে হল সব ঠিক তখন ফাইনাল শট এর জন্য ক্যামেরা শুরু হল। তবে ঝামেলা হল বাচ্চাটিকে নিয়ে, আর ধৈর্য্যের পরীক্ষা শুরু হল মিসেস সেনের জন্য। টেকের পর টেক হতে থাকল, এমন ইমোশনাল সিন,সুচিত্রা সেনের জন্য বেশ কষ্টকর হতে শুরু হল। অবশেষে যখন সব ঠিক চলছিল, তখন সুচিত্রা সেন নিজের সংলাপ একটু নিজের মত করে বলেন, যেটা খুব স্বাভাবিক বিষয় শুটিয়ের। তবে অভিনেতা অসিতবরণ বিষয়টা বুঝতে না পেরে থমকে যান। সঙ্গে সঙ্গে আবার কাট। এবার ধৈর্য্য চ্যুতি হল মিসেস সেনের। তিনি একঘর লোকের মাঝেই বলে উঠলেন যে “এমন আর্টিস্টেদের সঙ্গে কাজ করা যায়? অসম্ভব!”।
এই ঘটনায় অভিনেতা অসিতবরণ মুখ নিচু করে দাঁড়ানো, অপমানে কালো হয়ে গেছে তাঁর মুখ। এই দৃশ্য দেখে আমার মাথাও গরম হয়ে গিয়ে বলে ফেললাম, ” ওঁর সঙ্গে কাজ করা যায় কি না তা পরের কথা। যা ব্যবহার করলেন, আপনার মতো আর্টিস্ট এর সঙ্গেও কাজ করা যায় না।’ যেই না বলা দপ্ করে জ্বলে উঠল মিসেস সেনের চোখ। পৌরাণিক যুগ হলে হয়তো তৎক্ষণাৎ ভস্ম হয়ে যেতাম। এক সেকেন্ড আর অপেক্ষা না করে তিনি সেট থেকে বেড়িয়ে সোজা মেকআপ রুমে। আমি বুঝলাম ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছি। এই ছবি আর হবে না। অনেকক্ষণ আমি সেটের মধ্যেই বসে থাকলাম। সব আলো নিভে গেছে। এমন সময় ইলকট্রিশিয়ান পাহাড় সিং জানিয়ে দিল ব্রেক ফর লাঞ্চ।
ইউনিট এর অনেকে এসে বললেন, মিসেস সেন গুম হয়ে বসে আছেন, তাঁকে গিয়ে সরি বলে মিটমাট করে নিতে। আমি ভেবে দেখলাম, এই ছবি থেকে আমার সরে যাওয়াই ভাল , অন্য পরিচালক কাজ করে ফেলবেন। এর পর নিশ্চিত আমার সঙ্গে সুচিত্রা সেন কাজ করবেন না। কিছু সময় পর যা ঘটল, তা আমার কল্পনার বাইরে,শুটিং ফ্লোরে আমি বসে চা বিস্কুট খাচ্ছি। দেখলাম কয়েক জন ফ্লোরে আসছে, সামনে মিসেস সেন। আমি ভাবলাম আবার কিছু কড়া কথা শোনাতে আসছেন। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসেস সেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। উনি আমার হাত ধরে বললেন, ” প্লিজ একটু কালোদা (অসিতবরণ) কে ডাকুন। আমি সবার সামনে ক্ষমা চেয়ে নেব”। আমি শুধু অবাক নয় অভিভূত হয়ে গেলাম। এর পর কালো দাকে ডেকে পাঠানো হল, মিসেস সেন ক্ষমা চাইতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন অসিতবরণ, যাকে আমরা সকলে কালো দা বলেই ডাকি। আবার শুটিং শুরু হয়ে গেল।
আসলে সিনেমার সংলাপ চরিত্র, দর্শকদের ভালোবাসা ধীরে ধীরে প্রত্যেকের মধ্যে ইগো তৈরি হয়। তবে প্রকৃত শিল্পী যারা তাঁরা এই ইগো কাটিয়ে ওঠে। তাই তাঁরা তাদের কাজের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকেন। সুচিত্রা সেন তেমনই এক শিল্পী তথা মানুষ।