সত্যজিৎকে চরম কটাক্ষ উৎপল দত্তর! বাঙালির প্রিয় ফেলুদা চরিত্রকে কেন সমালোচনায় ধুয়ে দিয়েছিলেন মগনলাল মেঘরাজ?

সত্যজিতের এই গোয়েন্দাকে মোটেই পছন্দ ছিল না জয়বাবা ফেলুদা নাথের মগনলাল মেঘরাজের অর্থাৎ কিংবদন্তি অভিনেতা, নাট্যকার উৎপল দত্তর। ছবির পর্দায় ফেলুদার হাতে জব্ধ হলেও, বাস্তবে কিন্তু ফেলুদাকে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

সত্যজিৎকে চরম কটাক্ষ উৎপল দত্তর! বাঙালির প্রিয় ফেলুদা চরিত্রকে কেন সমালোচনায় ধুয়ে দিয়েছিলেন মগনলাল মেঘরাজ?

|

Jun 01, 2025 | 2:00 PM

চারমিনার সিগারেটের হলুদ প্যাকেট। পঞ্জাবির উপরে উলের চাদরের প্রলেপ। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, চোখে-মুখে বুদ্ধি, জ্ঞানের ঝলকানি। হ্যাঁ, বাঙালির আবেগ, বাঙালি গর্ব, সর্বপরি বাঙালির ‘ইনটেলেক্ট আইকন’ প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ফেলুদা এমন এক গোয়েন্দা, যা ভাইপো তোপসের হাত ধরে বাঙালির আবেগে মিশে যায়। সত্যজিৎ রায় ফেলুদাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন, যা আপামর বাঙালির স্টাইলকে উসকে দেয় বার বার। তাঁর চলাফেরা, কথা বলা, ধূমপানের স্টাইল, মগজাশাস্ত্র খাটানো, সবই যেন বার বার রপ্ত করতে চায় মধ্যবিত্ত বাঙালি। তবে সত্যজিতের এই গোয়েন্দাকে মোটেই পছন্দ ছিল না জয়বাবা ফেলুদা নাথের মগনলাল মেঘরাজের অর্থাৎ কিংবদন্তি অভিনেতা, নাট্যকার উৎপল দত্তর। ছবির পর্দায় ফেলুদার হাতে জব্ধ হলেও, বাস্তবে কিন্তু ফেলুদাকে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তিনি। তার নেপথ্যে অবশ্য অভিনেতা তুলে ধরেছিলেন এক জোরালো বক্তব্যকে।

বিষয়টা একটু বিশদে বলা যাক। উৎপল দত্তর গোটা জীবনটাই আবর্তিত হত থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে। রুপোলি পর্দায় দাপিয়ে অভিনয় করলেও, উৎপলের প্রাণভ্রমর ছিল নাটকের মঞ্চ। তাঁর কাছে নাটক শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, ছিল দিন বদলের হাতিয়ার। যেখানে ফুটে উঠত শ্রেণি সংগ্রামের কথা। উৎপল দত্ত সত্যজিতের ফেলুদা চরিত্রকেও এই শ্রেণি সংগ্রামের মাপকাঠিতেই বিচার করেছিলেন। তাঁর কাছে ফেলুদা ও তোপসে এই দুটি চরিত্র ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির সন্তান। তত্ত্বের ভাষায় পেটি-বুর্জোয়া। একদিকে ফেলুদার আচার-আচরণ, পোশাক, জীবনযাত্রা, মূল্যবোধের মধ্যে মধ্যবিত্ত বাঙালির গুণাগুণ স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অপরদিকে ফেলুদার মগজাস্ত্র বা ইন্টিলিজেন্স অর্ডিনারি নয়, ছিল একস্ট্রাঅর্ডিনারি। যা কিনা ইংরেজি শিক্ষা ও তার থেকেই চেতনার উন্মেষ হওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালির চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে অনেকটাই তফাতে চলত। উৎপলের মতে, মধ্যবিত্ত বাঙালির যে ধরনের দিনযাপন, সেখান থেকে এমন ত্রুটিহীন গোয়েন্দার আর্বিভাব হতে পারে না। তাঁর কাছে ফেলুদা আসলে বাঙালির মোড়কে থাকা পাশ্চত্যের গোয়েন্দার এক রূপমাত্র। উৎপল দত্তর ভাষায়, শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা চরিত্র বুর্জোয়া সাম্রাজ্যেই তৈরি হয়। যেখানে গোয়েন্দাগিরি একটা লাক্সারি পেশা। তাই তো লম্বা বড় কোর্ট, মুখে পাইপ দিয়ে রহস্য সমাধান করা যায়। কেননা, হোমসের দাদা ছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানির উচ্চপদাধিকারি কর্মচারী। তাঁর মক্কেল ছিল বিত্তশালীরা।

উৎপল দত্তর কথায়, ফেলুদা চরিত্রের আর্বিভাব যে সময়ে, তখন মধ্যবিত্ত যুবকরা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন। সারাদিন কাটে তাঁদের রুজি-রোজগারে চিন্তায়। সেখানে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দাগিরি করাটা নিছকই বড়লোকি শখ। এছাড়াও, ফেলুদার সংসার কীভাবে চলত? তাঁর সব মক্কেল তো কৈলাশ চৌধুরী বা দীননাথ লাহিড়ীর মতো কেউকেটা নয়! তখন তো কলকাতা শহরে সোনার কেল্লার মুকুল ধরের বাবা সুধীর ধরের মতো ছাপোষা মানুষেরই আনাগোণা! সত্যজিতের ফেলুদা চরিত্র নিয়ে ঠিক এখানেই আপত্তি ছিল উৎপল দত্তর। তাঁর কাছে ফেলুদা গোয়েন্দা ছিল ম্যাড়ম্যাড়ে এক জীব।

ফেলুদা সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে উৎপল দত্ত, সত্যজিতের ফেলুদা সৃষ্টির আরেকটি কারণও স্পষ্ট করেছিলেন। উৎপল দত্তর কথায়, ফেলুদার মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের একঘেয়ামি দিক থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, সেই কারণেই উৎপল দত্তর কাছে ফেলুদা প্রাইভেট ডিটেকটিভ নয়, বরং ছিল এক রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের ডাকাবুকো নায়ক।

তথ্যঋণ– ‘টুওয়ার্ডস আ রেভেলিউশনারি থিয়েটার’, শ্রীদত্ত
শিবাজী আইচ, সিলি পয়েন্ট, ফিচার