অনন্যা গুহ
খাই-খাই অনুভূতিটার সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। তবে এই খাই-খাই রোগের পরিণতি যে কী ভয়ানক হতে পারে, তা অবশ্য অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। ছেলেবেলায় মা-কাকিমার কাছে একটা কথা আমরা কমবেশি সবাই শুনে এসেছি—চোখের খিদে। চোখের খিদের সাধারণ লক্ষণ খুব সহজ। অর্থাৎ যা দেখবেন, তাই-ই খাওয়ার ইচ্ছে। তা পেট ভর্তি থাক আর নাই-ই থাক। ছেলেবেলার এই অভ্য়াসের পোশাকি নাম হল ‘বিঞ্জ ইটিং’ (Binge Eating)। হ্যাঁ, চিকিৎসা বিজ্ঞান (Medical Science) এবং মনস্তত্ত্ব (Psychology)-এর ভাষায় একে এটাই বলা হয়। তবে ছেলেবেলার মতো এই অভ্যাসকে এতটা লঘু করে দেখলে চলবে না। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অভ্যাসের পরিণাম হতে পারে ভয়ানক। দেশ জুড়ে বহু মানুষ এই বিঞ্জ ইটিং ডিজ়অর্ডার (Binge Eating Disorder)-এর শিকার।
বিঞ্জ ইটিং আসলে কী?
এক কথায় একটানা অত্যধিক খাওয়ার প্রবণতাকেই বিঞ্জ ইটিং বলা হয়। এই সমস্যার ফলে জিভে কোনও লাগাম থাকে না। হাতের কাছে যা রয়েছে, তাই-ই খেয়ে ফেলার ইচ্ছে তৈরি হয়। চাইলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তাই-ই নয়, জানেন কি মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই বিঞ্জ ইটিং ডিজ়অর্ডারের? বুলিমিয়া নার্ভোসা এবং অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার সঙ্গে সম্পর্ক এই রোগের। মোবাইলে, ট্যাবে অথবা স্মার্ট টেলিভিশনে যেভাবে একটানা ওয়েব সিরিজ় দেখা হয়, সেভাবেই একটানা এটা-ওটা-সেটা খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় এই বিঞ্জ ইটিং-এর ক্ষেত্রে।
শরীরে বিঞ্জ ইটিং-এর প্রভাব:
শরীরের জন্য় এই বিঞ্জ ইটিংয়ের অভ্যাস ভীষণই ক্ষতিকারক। কারণ এই অভ্যাস পাচনতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দেয়। অত্যধিক খাবার খেয়ে ফেলার ফলে শরীরে ক্ষতিকারক টক্সিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ফলে লিভারের উপর চাপ পড়ে। আর এতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে স্থূলতার সমস্যা।
কী করে মুক্তি পাবেন এই সমস্যা থেকে?
এই সমস্যা থেকে মুক্তির বেশ কিছু পথ রয়েছে। জানুন কী করবেন…
স্বাস্থ্য়কর খাবার খান:
দৈনন্দিন ডায়েটে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বেশি করে স্বাস্থ্যকর খাবার খান। শাকসবজি, বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। এছাড়া ফাইবারযুক্ত খাবারের পরিমাণ বাড়ান। পক্রিয়াজাত ফ্যাট এড়িয়ে চলুন। এতে উপকার পাবেন।
স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্ট:
এই সমস্য়া থেকে মুক্তির আরও একটি ভাল উপায় হল দিনের শুরুটা করুন স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্ট দিয়ে। এক্ষেত্রে ওটস, ডালিয়া, ডিম সেদ্ধ বা এক বাটি ফল খেতে পারেন। যদি দুধ খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তবে এক গ্লাস দুধও খেতে পারেন।এবং কখনওই লাঞ্চ মিস করবেন না। খাবার খাওয়ার সময় আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হল ধীরে-ধীরে খেতে হবে। এবং অবশ্যই যেটা মাথায় রাখতে হবে, তা হল: খাবার খাওয়া কখনও মাল্টিটাক্সিং-এর অন্তর্গত কোনও কাজ নয়। অর্থাৎ খাবার যখন খাবেন, বিশেষত ব্রকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার, তখন শুধু খাবারটাই মন দিয়ে খাবেন। খেতে-খেতে ট্যাপটপে কাজ অথবা মোবাইলে চোখ রেখে ইউটিউব বা সিরিজ় দেখতে-দেখতে খাবার খাবেন না।
জল খান:
সুস্থ থাকতে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নিয়মিত ৩-৪ লিটার জলের প্রয়োজন। এই ব্রিঞ্জ ইটিংকে রুখতে সারাদিন প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। কারণ শরীরের আর্দ্রতা বজায় থাকলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
খাওয়ার সময় মেনে চলুন:
সারাদিনে ৩ বার মিল নেওয়ার চেষ্টা করুন। এবং এর মাঝে হালকা খাবার খেতে পারেন। দু’টো মিলের মাঝে খুব বেশি ব্যবধান যেন না হয়। ৩-৪ ঘণ্টার ব্যবধানে খাবার খান।
মানসিকভাবে সজাগ থাকুন:
মাঝে মধ্যে ভাজাভুজি বা ফাস্টফুড খাওয়া হয়েই যায়। তবে এই সময় চেষ্টা করতে হলে মানসিকভাবে সজাগ থাকার। ধীরে-ধীরে খান এবং একটা সময়ের পর নিজেকে বোঝান যে, অনেকটা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এবার থামা জরুরি।
বিঞ্জ ইটিং-এর সঙ্গে মানসিক যোগ:
অত্য়ধিক খাবার খাওয়ার ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আর এই ঘটনা ঘটলেই অ্য়াড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে কর্টিসল হরমোন ক্ষরণ হয়, যা খিদেকে দ্বিগুণ করে দেয়। এটাই বিঞ্জ ইটিং-এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ। ন্য়াশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের গবেষণাপত্র অনুযায়ী, এই বিঞ্জ ইটিং-এর বহু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল, কাজের চাপ, সম্পর্কে টানাপোড়েন, অর্থাভাব ইত্য়াদি। এছাড়াও অ্য়াঞ্জাইটি অর্থাৎ দুশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদ অর্থাৎ ডিপ্রেশনও রয়েছে এই তালিকায়। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষণা বলছে, এই বিঞ্জ ইটিং-এর প্রবণতা পুরুষদের থেকে নারীদের মধ্যে অনেকটাই বেশি। তবে এর থেকে মুক্তিরও পথ রয়েছে।
বিঞ্জ ইটিং যখন মানসিক সমস্যা, তখন কী করবেন:
ধ্যান করুন:
নিয়মিত ধ্যান করুন। এতে মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন এবং মন ও মাথা দুই-ই শান্ত থাকবে। সেই সঙ্গে কমবে বিঞ্জ ইটিং-এর প্রবণতা।
প্রকৃতির বুকে সময় কাটান:
প্রকৃতির চেয়ে পরম বন্ধু আর কেই-ই বা হতে পারে! তাই প্রকৃতির কোলে বেশি করে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। প্রকৃতির মাঝে বই পড়ার অভ্যাস করুন।
সমর্থনের হাত খুঁজুন:
এমন কাউকে খুঁজুন, যার কাছে নির্দ্ধিধায় সবটা খুলে বলতে পারবেন। কারণ এই সময় মানসিকভাবে সাহায্যের একটা কাঁধ খুব প্রয়োজন হয়। এতে সেরে ওঠার তাগিদটা আরও তীব্র হতে পারে।
নিজেকে বোঝান:
যখনই খাওয়ার ইচ্ছে জাগবে, তখনই নিজেকে বোঝান আদৌ কি খিদে পেয়েছে? নাকি এটা নিছকই চোখের খিদে?
চোখের সামনে ফাস্টফুড রাখবেন না:
চোখের সামনে যত খাবার দেখবেন, ততই খাওয়ার ইচ্ছে বাড়বে। তাই চেষ্টা করুন ফাস্টফুড, ভাজাভুজি জাতীয় খাবার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলার।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র তথ্যের জন্য, কোনও ওষুধ বা চিকিৎসা সংক্রান্ত নয়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।