AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

করোনার চোখ রাঙানিতে ফের বন্ধ স্কুল, ঘরবন্দি বাচ্চাদের মান-অভিমান কীভাবে সামলাবেন মা-বাবারা?

সন্তান যদি খুব বেশি ডিজিটাল ডিভাইসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয় তাহলে বকাঝকা বা মারধর করে নয়, বরং ওদের বুঝিয়ে বলুন। সন্তানকে অবশ্যই ডিজিটাল টাইম দিন। ওদের স্পেস দিন। কিন্তু নজর রাখুন। আর ডিজিটাল মাধ্যম ঘাঁটার সময়টা বেঁধে দিন।

করোনার চোখ রাঙানিতে ফের বন্ধ স্কুল, ঘরবন্দি বাচ্চাদের মান-অভিমান কীভাবে সামলাবেন মা-বাবারা?
অভিভাবকের মনে যাই-ই চলুক, যতই নেতিবাচক ভাবনা আসুক, বাচ্চাদের সামনে একদমই প্রকাশ করবেন না। না-হলে বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে যাবে।
| Updated on: Apr 24, 2021 | 2:51 PM
Share

আছে ক্লাসরুম, আছে চক, আছে টিচারের বকবক…

নাহ্, গত এক বছর ধরে এসব আর নেই পড়ুয়াদের জীবনে। ঠিক নেই, সরাসরি এমনটাও বলা যায় না হয়তো। সবকিছুর আগেই জুড়ে গিয়েছে একটা শব্দ ‘ভার্চুয়াল’। ক্লাস, পরীক্ষা… সবই এখন অনলাইনের জমানা।

ভারতবর্ষের স্কুলগুলো ঠিক কতদিন ধরে বন্ধ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, বেশিরভাগ লোকই মাথা চুলকে বলবেন, ‘সে তো বহুদিন’। কড় গুণে সঠিক হিসেব করা সত্যিই মুশকিল। মাঝে অবশ্য কিছু স্কুল খুলেছিল। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ফের তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

আর এই সবকিছুর দাপটে আবারও ঘরবন্দি হবে কচিকাঁচারা। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই, খেলতে যাওয়া নেই, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বড় সমস্যায় পড়েছে স্কুল পড়ুয়ারা। এ সময় নানা মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে ওদের মধ্যে। কিন্তু অনায়াসেই সেইসব সমস্যার অনেকটা এড়িয়ে চলা যায়, যদি মা-বাবারা আর একটু সচেতন হন, তাহলে।

এমন নেতিবাচক পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিক কেমন হবে বাবা-মায়েদের রসায়ন? এই নিয়ে TV9 বাংলা কথা বলেছিল পেরেন্টিং কনসালট্য়ান্ট পায়েল ঘোষের সঙ্গে। মা-বাবাদের উদ্দেশে কী বার্তা দিলেন তিনি?

পায়েল: আমি প্রথমে কয়েকটা কথা বলব। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগমনের পরিস্থিতিতে এগুলো কিন্তু প্রত্যেক মা-বাবার মাথায় রাখা উচিত।

১। বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর একটু বেশি করে নজর দিতে হবে। ওরা অনেককিছু আশা করে রয়েছিল। কিন্তু সবটাই ঘেঁটে গিয়েছে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রুটিনমাফিক কিছু জিনিস করতে হবে। যেমন ধরুন বাচ্চাদের সকালবেলা বাড়ির পাশেই একটু সাইক্লিং করতে নিয়ে যেতে হবে। মা-বাবা কর্মরত হলেও এটা করতেই হবে। কারণ বাইরে আর পাঁচজনকে দেখলে শিশুমন বুঝবে যে, না সব ঠিকই আছে।

২। ওদের সামনে নেতিবাচক কথা বলবেন না। বারবার বাচ্চাদের সামনে বলবেন না যে, ইশশশ… ওদের অবস্থাটা ভাব। কী হবে? তার চেয়ে বরং পজ়িটিভভাবে ভাবুন। মা-বাবারা ভাবতে চেষ্টা করুন যে, কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা সকলে যেন সুস্থ থাকি, তাই-ই আমরা বাড়িতে রয়েছি। পজ়িটিভ ভাইবস থাকাটা খুব প্রয়োজন। বাচ্চাদের সামনে বারবার নেগেটিভ কথা বললে ওরা স্ট্রেসড হয়ে যায়। যার ফলে ওদের আচরণে প্রভাব পড়ে।

৩। পড়াশোনার ব্যাপারটা একটু ইন্টারেস্টিং করে তুলুন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ইন্টারঅ্যাকটিভ লার্নিংয়ের দিকে জোর দিন। আর একটু বড় যারা, তাদের ক্ষেত্রে বারবার ‘পড়তে বস’ বলে ঘ্যানঘ্যান করবেন না। বরং মা-বাবারা ওদের বলুন, “একটু ব্রেক নাও। তারপর আবার পড়তে বসো।” একঘেয়ে জীবনে ঘ্যানঘ্যানে অভিভাবক হওয়ার বদলে একটু মজাচ্ছলে ওদের পড়ানোর চেষ্টা করুন।

৪। বাড়িতে নিউজ় চ্যানেল খুলে কিংবা এমনিও করোনার নেতিবাচক পরিসংখ্যান নিয়ে বাচ্চাদের সামনে একেবারেই আলোচনা করবেন না। এর ফলে শিশুমনে খুব খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। মা-বাবাদের কিন্তু পজ়িটিভ থাকতেই হবে। নিজের মনে যাই-ই চলুক, বাচ্চার সামনে সেটা প্রকাশ করবেন না।

৫। সাধারণত মা-বাবারা সন্তানকে যতটা সময় দেন, তার থেকে একটু বেশি সময় দিন। আর সেটা অতি অবশ্যই ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া হতে হবে। এই ডিজিটাল ডিটক্সটা খুব প্রয়োজন। বাচ্চার সঙ্গে গল্প করুন, নানা রকমের মজার খেলা খেলুন, ওদের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শুনুন, ওদের কথা মন দিয়ে শুনুন। এই প্যান্ডেমিকের সময় এটা খুব প্রয়োজন।

৬। একদম মারধর বা বকাঝকা করবেন না। সবাই স্ট্রেসে আছে। ওরা আরও বেশি সমস্যায়। তাই চিৎকার করে বকা, ধমক, মারধর এগুলো কিন্তু একদম বন্ধ করতে হবে।

যাঁদের সন্তান বয়ঃসন্ধি পর্যায়ে রয়েছে…

পায়েল: এই সময়ে বাচ্চারা নিজেদের সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করে। তাই তার মধ্যে সহজাতভাবে যা-যা আচরণ দেখবেন, সেটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াটা আগে শিখতে হবে মা-বাবাদের। টিপিক্যাল ঘ্যানঘ্যানে অভিভাবক হলে কিন্তু বিপদ। মা-বাবাদের সন্তানের প্রতি নিশ্চয় শাসন থাকবে, বক্তব্য থাকবে… কিন্তু বারবার এক জিনিস নিয়ে কথা না বলাই ভাল।

সন্তান যদি খুব বেশি ডিজিটাল ডিভাইসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয় তাহলে বকাঝকা বা মারধর করে নয়, বরং ওদের বুঝিয়ে বলুন। ধরুন সাইবার ক্রাইম, সাইবার সিকিওরিটি আইন এগুলো নিয়ে হাল্কা আলোচনা করতে পারেন। ডার্ক ওয়েব সম্পর্কে আপনার সন্তানকে অবগত করুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অচেনা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে সে যে ভুয়ো লোক হতে পারে, সেটা বুঝিয়ে বলুন। বকে, ধমকে, মেরে একেবারেই নয়। তাহলে হিতে বিপরীত হবে।

সন্তানকে অবশ্যই ডিজিটাল টাইম দিন। ওদের স্পেস দিন। কিন্তু নজর রাখুন। আর ডিজিটাল মাধ্যম ঘাঁটার সময়টা বেঁধে দিন। এই বয়সে অনেকেই পর্নোগ্রাফিক সাইট দেখে। এটা জানতে পারলেই মা-বাবারা একটা ‘গেল, গেল’ রব তুলে হা-হুতাশ করতে বসেন। এই বিষয়টা কিন্তু খুব স্বাভাবিক। বয়ঃসন্ধি পর্যায়ে একটি ছেলে বা মেয়ে পর্নোগ্রাফি দেখতেই পারে। আপনার কাজ ওকে বুঝিয়ে বলা যে, ওগুলোর সবটা বাস্তব নয়। অনেক রঙ চড়ানো রয়েছে। ফ্যাব্রিকেশন যে রয়েছে, সেটা তো বোঝাতে হবে। বাবা ছেলেকে না-পিটিয়ে কিংবা মা মেয়েকে না-বকে বরং একদিন বসে আড্ডা দিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলুন। দেখবেন ওরা ঠিক বুঝবে।

আরও পড়ুন- সন্তান হচ্ছে না, অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষের তীব্র অনীহা; রইল জরুরি আলোচনা

বয়ঃসন্ধির সময় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেক অনুভূতি কাজ করে। হয়তো ওরা হঠাৎ করে রেগে গেল। এটা নিয়ে নাগাড়ে দোষারোপ করবেন না। বরং চুপ করে গেলে ওদের মধ্যেই অনুতাপ হবে। ওরা ঠিক-ভুলের বিচার করতে শিখবে। বাড়ির ছোটখাটো কাজে ওদের যুক্ত করুন। মজা করে বলুন, বিছানাটা পরিষ্কার করে দিলে আপনি সেই সময়ে একটু ফেসবুক করবেন। এই সময়টায় ভীষণভাবেই আমাদের সকলের জীবনে ‘হিউমার’ প্রয়োজন। আর বাচ্চাদের তো সবচেয়ে বেশি।

সিঙ্গল পেরেন্টদের ক্ষেত্রে কী বার্তা দেবেন?

পায়েল: বাচ্চাদের সঙ্গে ‘ওপেন কমিউনিকেশন’ করুন। ব্যাপারটা এরকম যে আপনার দৈনিক রুটিন বা পরিস্থিতি ওকে বুঝিয়ে বলুন। এর পাশাপাশি মাঝে মাঝে অফিসে কাজের ফাঁকে একটু ভিডিয়ো কল করুন। খেয়েছ, ঘুমিয়েছ, পড়াশোনা করেছ… এসব কথা নয়, কোনও মজার কথা শেয়ার করুন। বা একদম সাধারণ কথাই বলুন মজা করে। এছাড়াও বাড়ির ছোটখাটো ব্যাপারে সন্তানকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। এর ফলে আপনার সন্তান অনেক বেশি ‘ম্যাচিওরড’ হবে।

বেশিরভাগ বাচ্চার অভিযোগ থাকে মা-বাবা সময় দেন না… এক্ষেত্রে অভিভাবকদের কী বলবেন?

পায়েল: এই সমস্যাটা বোধহয় সিঙ্গল পেরেন্টদের একটু বেশিই শুনতে হয়। প্রথমে আমি একটা কথা বলি পেরেন্টিং কিন্তু মা-বাবার প্রায়োরিটি লিস্টে থাকা উচিত। তা তিনি সিঙ্গল হোন বা ডুয়াল। সন্তান যখন আমার, তাকে সময় দিতেই হবে। এটাই রুটিন করে নিন। বাচ্চাদের কিন্তু দিনে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় দিলেই হয়। কিন্তু ওই সময়টুকু তার হবে। অফিসের ফোন ধরে বা ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ ঘাঁটলে হবে না। প্রয়োজনে অফিসে আগাম জানিয়ে রাখুন যে ওইটুকু সময় আপনি থাকবেন না। আর প্রতিদিন এই সময়টুকু সন্তানকে দিন। আজ দিলেন, তারপর আবার তিনদিন পর বাচ্চার সঙ্গে বসলেন, তাহলে হবে না। রোজই সন্তানকে সময় দিতে হবে, দিতেই হবে। তা সে আপনি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করুন কিংবা অফিস যান।

বাবাদের ভূমিকা এখানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

পায়েল: বাবার সান্নিধ্য কিন্তু সব বাচ্চার জন্য খুব প্রয়োজন। কোনও অফিসেই নাগাড়ে কাজ চলে না। ওয়ার্ক ফ্রম হোমে সামান্য ব্রেক তো পাওয়াই যায়। এবার সেই সময় বাবা দরজা বন্ধ করে নিজে গেম খেলবেন, সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটবেন নাকি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে একদান লুডো বা দাবা খেলবেন, সেটা তো বাবাকেই ঠিক করতে হবে। ইচ্ছে না করলেও সন্তানকে ১০-১৫ মিনিট… এটুকু সময় দিন। চেষ্টা করুন যদি একসঙ্গে দুপুরের খাবারটা খাওয়া যায়। বাবারা বরং সকালে একটা চেক লিস্ট তৈরি করুন। সেই মতো সন্তানকে সময়ও দিতে পারবেন।

পরীক্ষা বাতিল, স্কুল বন্ধ, সেশন পিছিয়ে যাচ্ছে… বাচ্চাদের কীভাবে বুস্ট-আপ করবেন বাবা-মায়েরা?

পায়েল: অভিভাবকের মনে যাই-ই চলুক, যতই নেতিবাচক ভাবনা আসুক, বাচ্চাদের সামনে একদমই প্রকাশ করবেন না। না-হলে বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের মধ্যে ‘এক্সট্রিম ইমপ্যাক্ট’ কী হতে পারে?

পায়েল: বাচ্চা হোক বা বয়ঃসন্ধি, সাংঘাতিক ভাবে ডিজিটাল অ্যাডিকশন হচ্ছে। বয়সোপযোগী নয় যা, সেটাই ওরা দেখেছে। ফলে একটা রেকলেস, ক্রিমিনাল মাইন্ড সেট-আপ তৈরি হতে পারে। অতিরিক্ত ডিজিটাল আসক্তি কিন্তু সত্যিই ভয়ঙ্কর। তাই সন্তানের ডিজিটাল ডিভাইস বা সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটার সময় বেঁধে দিন। ডেটা কমিয়ে দিন, বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলুন। তবে চরম শাসন করবেন না।

গ্র্যাফিক্স ও অলংকরণ: অভিজিৎ বিশ্বাস