AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

কতটা মন খারাপ হয় মনোবিদদের? কী বলছেন স্বয়ং মনোবিদ-সমাজকর্মীরা?

প্যানডেমিকের পরিস্থিতি তো মনোবিদদের কাছেও নতুন। তাঁরা কীভাবে মন ভাল রাখছেন? অন্যের মন ভাল রাখার উপায় বলে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের মনের যত্ন নিতে পারছেন তো?

কতটা মন খারাপ হয় মনোবিদদের? কী বলছেন স্বয়ং মনোবিদ-সমাজকর্মীরা?
| Updated on: Jun 05, 2021 | 3:30 PM
Share

করোনা আতঙ্ক, লকডাউন পরিস্থিতি একেবারে নতুন আমাদের কাছে। শারীরিক অসুস্থতা তো আছেই। একই সঙ্গে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়াও অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই দুঃসময়ে শরীরের পাশাপাশি মন ভাল রাখাও অত্যন্ত জরুরি। শরীর খারাপ হলে তার যেমন চিকিৎসা হয়, মন খারাপের চিকিৎসাতেও মনোবিদের দ্বারস্থ হই আমরা। মনোবিদের তো মন খারাপ হতে পারে। এই কঠিন সময়ে হয়তো তাঁর পরিবারেরও কেউ অসুস্থ, তাঁরও উদ্বেগ রয়েছে। হয়তো প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে সামান্য শোকতপ্ত হয়ে থাকার সময়টুকুও পাননি তিনি। পেশাগত দায়বদ্ধতায় ফের অন্য কারও মন খারাপের সমাধানসূত্র দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্যানডেমিকের পরিস্থিতি তো মনোবিদদের কাছেও নতুন। তাঁরা কীভাবে মন ভাল রাখছেন? অন্যের মন ভাল রাখার উপায় বলে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের মনের যত্ন নিতে পারছেন তো? তিনজন বিশিষ্ট মনোবিদ এ বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন।

রত্নাবলি রায় (মনোবিদ/সমাজকর্মী)

প্রথম যেটা বলতে চাই, ব্যক্তিগত ভাল থাকার চেয়েও সমষ্টির ভাল থাকা নিয়ে আমি অনেক বেশি চিন্তিত। আমার কনস্টিটিউয়েনসির মানুষের অক্সিজেন সংকট কীভাবে মেটাব, তাঁদের কোভিড থেকে কীভাবে নিরাপদ রাখব, কীভাবে তাঁরা ভ্যাকসিন পাবেন, এগুলো আমার কাছে এই মুহূর্তে প্রায়োরিটি।

মনোবিদ বা সমাজকর্মী হিসেবে এই সময়ে ভাল থাকার চাপ নিচ্ছি না। কারণ আমি মনে করি, যদি ভাল থাকার চাপ নিই, সেটাও একটা চাপ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি। আমার অনুভূতি, আবেগের প্রতি সৎ থাকতে চাইছি। অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যে ইমোশন আসছে, সেটা নিয়েই চলছি।

ঢেউ আসে এবং যায়। ঢেউ তো কখনও সর্বদা খারাপও থাকবে না, কখনও সর্বদা ভালও থাকবে না। এই ঢেউয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাল থাকাটাও আশা করি না, আবার খারাপ থাকাটাও আশা করি না। আমার অতিরিক্ত প্রত্যাশা নেই। সমাজকর্মী, মনোবিদ হিসেবে লক্ষ্যগুলো সে ভাবেই সাজাচ্ছি। এই সময় অতিরিক্ত ভাল থাকা-হ্যাপিনেস-এটা জোর করে করতে গিয়ে আমাদের ভিতরের ভয়, উদ্বেগকে ডিনায়েলে পাঠিয়ে দিলে সেটা ইতিবাচক হবে না। সেটা স্ট্রেস আরও বাড়াবে। যাঁরা বলছেন, টিভি দেখবেন না, খবর দেখবেন না, তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। সবাই এই সময় বলছেন, নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে যদি স্ট্রেস হয়, সেটা নেব কেন? নতুন দক্ষতা অর্জন করতে তো অনেকে পারবেন না, সকলের সেই সুযোগ নেই, সেটা সম্ভবও নয়। তা হলে তাঁরা কি ভাল থাকবেন না?

Ratnaboli Ray

এই পরিস্থিতিতে আমাদের নতুনভাবে একে-অপরের সঙ্গে কনভারসেশন চালানো শিখতে হচ্ছে। আমরা মনোবিদ হলেও জানি না কীভাবে প্যানডেমিকের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। মনোবিদরা সব উত্তর দিতে পারবেন, সেটা প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। মনোবিদ হিসেবেও নতুন একটা পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে আমাদের।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মুহূর্তের থাকাতে বিশ্বাস করি। আগে কী হয়েছিল, আর ভবিষ্যতে কী হবে সেটা ভেবে এই সময়টা নষ্ট করি না। হোয়াট ইফ, এই প্রশ্ন বারবার মানুষের সামনে আসে। আমি সেই জায়গাতেই পৌঁছতেই চাই না। আমার যা করার, এখনই করে ফেলি।

আমার একটা নিজস্ব ছন্দ আছে, রুটিন আছে। সেটার সঙ্গে আর পাঁচটা লোকের রুটিন হয়তো মিলবে না। আমার সেই স্ট্রাকচারটা মেনে চলতে চেষ্টা করি। যখন যেটা অনুভূতি হচ্ছে, সেটার প্রতি সৎ থাকি।

রিমা মুখোপাধ্যায় (মনোবিদ)

শুধু প্যানডেমিক বলে নয়। সারা জীবনই আমাদের আপস্ অ্যান্ড ডাউনস্ থাকে। সেগুলো নিয়েই চলতে হয়। এই ধরনের প্রফেশনে একটা ইনভিজ়িবল মাস্ক পরতে হয়। এখন যে মাস্ক পরেছি নাক এবং মুখ ঢাকার, এর বাইরেও সাহস, কনফিডেন্সের মাস্ক পরতে হয়। সব সময় দেখাতে হয় আমাদের কোনও টেনশন নেই। শান্ত আছি। যাতে মানুষ আমাদের থেকে সাহস পান। তাঁদের উদ্বেগের কথা শুনে, আমরাও যে ভয় পাচ্ছি, আমাদেরও যে খারাপ লাগছে, সেটা দেখানো চলবে না।

আমি কাজে বাইরে যাচ্ছি। হাসপাতালে যাচ্ছি। অনলাইন, অফলাইন দু’ভাবেই রোগী দেখছি। প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি যে জিনিসে আমি ডিস্টার্বড ফিল করি, সেগুলো অ্যাভয়েড করি। পিপিই পরে কেউ যাচ্ছেন, কেউ মারা গেলেন কোভিডে, শ্মশানের ছবি-এগুলো অ্যাভয়েড করি। নিউজ় চ্যানেল একদম দেখি না। বিশেষ কোনও খবরের জন্য কখনও হয়তো দেখি। আমাদের বাড়িতে নিয়ম আছে, সারা দিন ধরে নিউজ় চ্যানেল চলে না। কনস্ট্যান্ট যে ভয়ের বাতাবরণ চলছে, হয়তো দেখছি না, কিন্তু যাতায়াতের পথে চোখে পড়ল, সেটাও এফেক্ট করে।

কাজ থেকে ফিরে এসে কাজ সম্বন্ধে আর ভাবি না। সুইচ অফ করার চেষ্টা করি। কাজের ইন্টারেস্টিং কিছু হলে সেটা নিয়ে পড়াশোনা করলাম, সেটা আলাদা। যে ঘটনাগুলো শুনে ভয়ানক লেগেছে, সেটা না ভাবতে চেষ্টা করি। অনেক সময় সেটা সহজ হয় না। কিন্তু চেষ্টা করি।

কিছু অ্যাক্টিভিটি করে মন ডিসট্র্যাক্ট করি। বাড়িতে এসে খুব কম কথা বলি। কেউ হয়তো ভাবেন, আমি খোঁজ রাখি না। আসলে আমি বেছে-বেছে লোকের সঙ্গে কথা বলি। যাঁদের আমাকে প্রয়োজন, তাঁরা আমাকে ফোন করেই নেন। নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য বেশি কাউকে ফোন করি না।

সারা দিন পেশার কারণেই অনেকের অনেক দুঃখের কাহিনি শুনতে হয়। লোকে ভাবে আমাদের কিছু এফেক্ট করে না। তা তো নয়। আমি একটা মানুষ-এটা আমার প্রথম পরিচয়। সেনসেবেল, ইনোশনাল মানুষ। চারপাশে যা হচ্ছে, তাতে যথেষ্ট ডিস্টার্বড।

Rima Mukherjee

ফোনের কথা বলছিলাম। চারপাশে অর্থাৎ বাস্তবে কী হচ্ছে, জানি তো। নতুন কোনও ইনফরমেশন তো কেউ ফোনে দেবে না। আরও ভয়ঙ্কর কী-কী জিনিস হচ্ছে, তা নিয়ে ফোনে বারবার আলোচনা করতে চাই না। বরং নিজের সঙ্গে সময় কাটাই। নিজের হবি নিয়ে থাকি। সেগুলো হেল্প করে। আমার স্বামীর কোভিড হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে থাকার অ্যারেজমেন্ট এমন, যে ওকে খাবার ঘরে পৌঁছে দিতাম আমি। আমার কোভিড রিপোর্ট না-আসা পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকতে হয়েছিল। তখন অনলাইন পেশেন্ট দেখেছি। কিন্তু পেশেন্টদের সামনে তো আমার উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারিনি। যখন খুব বেশি টেনশন হয়েছে, তখন নিজেকে বলতাম, পরের এক ঘণ্টা এতগুলো পেশেন্ট দেখতে হবে। এতটাই মনোযোগ দিয়ে কাজ করব, যে নিজের টেনশনটা মনে থাকবে না।

এক-এক সময় পেশেন্টদের থেকে পজ়িটিভ স্টোরিও শুনি। কত সাধারণ মানুষের মনের কত জোর, তাঁদের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে। সেটাও আমার কাছে বিরাট পাওনা। তাঁদের জীবনের ঘটনা আমাকে ইন্সপায়ার করে। সেটা প্যানডেমিকে আলাদা কিছু নয়। বরাবরই ইন্সপায়ার করে।

আমার মন ভাল করতে মিউজ়িক হেল্প করে। আমি নিজে পিয়ানো বাজাই। সেটাই হয়তো কেরিয়ার হওয়ার কথা ছিল। রেগুলার প্র্যাকটিস করা হয় না। এ ছাড়া আঁকতে শুরু করেছি নতুন করে। ট্রাইবাল আর্ট। আমার পোষ্য কুকুর আছে। সে-ও আমাকে ডিসট্র্যাক্ট করতে হেল্প করে। অনলাইনে ইন্টারেস্ট এরিয়া নিয়ে পড়াশোনা করি। আমি রিলিজিয়াস পার্সন নই। কিন্তু স্পিরিচুয়ালিটিতে বিশ্বাস করি। প্রচুর সিনেমা দেখি। বই পড়ি।

একেবারে শেষে বলব, আমি জীবনের থেকে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার জীবনে কেন কষ্ট, এ প্রশ্ন আমি কখনও করি না। যখন ভাবি, এত কিছু পেয়েছি। আমি ভালটাই পাব, খারাপ কিছু পাব না, এটা তো হতে পারে না। প্রত্যেকটা দিন আশীর্বাদ হিসেবে মনে করি। কাছের মানুষের লাইফও গ্রান্টেড হিসেবে মনে করি না। যা পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞ মনে করি। ক্রাইসিসের সময় কাল কী হবে, পরশু কী হবে ভাবি না। আগামী এক ঘণ্টা কীভাবে কাটাব, সেটা ভাবি। বেশি ডিস্টার্ব হয়ে গেলে যেখানে কারও সঙ্গে কথা বলা দরকার, তিনি সহকর্মী হতে পারেন, আমার তুতো বোন হতে পারে, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেও মন ভাল হয়ে যায়।

সুজিত সরখেল (এসএসকেএম হাসপাতালের সাইক্রিয়াটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর-চিকিৎসক)

সারা দিন বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কথা আমাদের শুনতে হয়। নানা রকম ঘটনা শুনলে এফেক্ট তো হয়ই। তার থেকে বেরনোর জন্য নিজেকে শাট ডাউন করে ফেলতে হয়। আমি সেটাই করি। অর্থাৎ প্রফেশনালি মন দিয়ে পেশেন্টের সঙ্গে সহমর্মী হয়ে তাঁর কথা শুনলাম। সলিউশনও দিলাম।

তারপর একটা সময় রাখতে হয়, যখন নিজেকে শাট ডাউন করতে হয়। নিজে ডিরেক্টলি এফেক্টেড হলে তো কাজ করা মুশকিল হবে। নিজের পুরো এফোর্ট দিয়ে কথা শুনলাম, হেল্প করলাম। নিজের ডেইলি-লাইফে যখন ফিরলাম, তখন শাট ডাউন করলাম।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, নিজেকে ডিসট্র্যাক্ট করা। বই পড়লাম। সিনেমা দেখলাম। যদি পড়াশোনা করতে ভাল লাগে, করলাম। এক্সসারসাইজ় খুব এফেক্টিভ। ফিজ়িক্যালি ঘাম ঝরানো দরকার।

Sujit Sarkhek

আর যদি সম্ভব হয় কিছুটা প্রকৃতির কাছে থাকলে সুবিধে। আমার বাড়ির কাছে পুকুর আছে। গাছ, পাখি, মাছ… সেটা খুব সাহায্য করে। বাড়ির বাগানে একটু ঘুরলাম। সকালে একটা ফুল ফুটেছে, গাছে নতুন পাতা এল, নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা ভীষণ আনন্দ দেয়। অর্থাৎ নতুন লাইফ জরুরি। মন ভাল রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার গান ভাল লাগে। যখনই সময় পাই, গান শুনলাম। গল্পের বই পড়ি, সিনেমা দেখি। ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে কনফারেন্সে আড্ডা দিই। যদিও ভার্চুয়াল আড্ডা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। প্যানডেমিক একটু ঠিক হলেই মাস্ক পরে বসে আড্ডা দেব। সামনাসামনি ওই এক্সপ্রেশনগুলো দেখাটাও মন ভাল রাখার ক্ষেত্রে এফেক্টিভ।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস