সন্তান হচ্ছে না, অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষের তীব্র অনীহা; রইল জরুরি আলোচনা

Sneha Sengupta |

May 04, 2022 | 3:22 PM

এমনটা তো হতেই পারে, নারীর দেহ সন্তানধারণের জন্য অনুকূল। আর সমস্যা পুরুষেরই? মোটামুটি এক এমএল বীর্যে ১৫ মিলিয়ান শুক্রাণু থাকতে হবে। ১০০টি শুক্রাণু খুঁজলে ৬০% নর্ম্যাল শুক্রাণু থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ৩০% পুরুষের বীর্য সংক্রান্ত সমস্যা। ৩০% মহিলাদের সমস্যা। ৩০% নারী-পুরুষ উভয়ের সমস্যা।

সন্তান হচ্ছে না, অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষের তীব্র অনীহা; রইল জরুরি আলোচনা
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

Follow Us

আমাদের সমাজ ‘পুরুষতান্ত্রিক’ (Patriarchal)। তার কান্না বারণ। তার দুর্বল হওয়া বারণ। তাকে তেজি হতেই হবে। বা তেজি হওয়ার ভান করতে হবে সারাক্ষণ। কেননা, সে ‘কর্তা’। বাড়ির ‘হেড’। তার কোনও খামতি থাকতেই পারে না! এমনটাই শিখিয়ে আমাদের সমাজ, সেই ছেলেবেলা থেকে। তার চোখ থেকে জল গড়ালে, এখনও বলা হয়, “মেয়েদের মতো কাঁদছ কেন? তুমি না ‘ব্রেভ’ ছেলে!” অর্থাত্‍, ছোট মাথায় গেঁথে দেওয়া হয় পুরুষ নারীর তুলনায় শক্তিশালী। কান্নাগুলো চেপে-চেপে, আবেগের বহিঃপ্রকাশ না করে-করে, পাথরে পরিণত হয় পুরুষের মন। অনেকসময় মনুষ্যত্বই হারিয়ে যায়।

এই কথাগুলো বলার সময় একটি ছবির দৃশ্য মনে আসছে বারবার। ছবিটির নাম ‘পার্চড’ (Parched)। একটি দৃশ্যে পরিচালক লীনা যাদব তুলে ধরেছিলেন সমাজের রূঢ় বাস্তবকে। লাজো (রাধিকা আপ্তে)-র সন্তান হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই অক্ষমতার আঙুল লাজোর দিকে। যেন সব খামতি লাজোরই। সমাজ ও স্বামীর চাপে লাজোও মেনে নেয় সাজানো ‘বাস্তব’। হঠাত্‍ একদিন লাজোর গর্ভে সন্তান আসে (কীভাবে সেটা সম্ভব হয়, সেই আলোচনা অন্য কোনওদিন)। খবরটি স্বামীকে জানাতেই বোমা ফাটে চার দেওয়ালের ভিতর। প্রতিদিনের মতো আবারও অত্যাচারিত হয় লাজো। মুহূর্তে বুঝতে পারে তার স্বামীর ক্ষোভের কারণ। আসলে দোষ লাজোর নয়। তার স্বামীই সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম। যে অক্ষমতার কথা সে বরাবর লুকিয়েছে লাজোর থেকে আর দোষ দিয়েছে তাকেই। এটাই আমাদের সমাজের চিত্র। দোষ যারই থাক, বলিকাঠে যেতে হয় নারীকেই!

সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে কেবল নারীর জরায়ু (Uterus) পরীক্ষা, ডিম্বাণু (Ovum) পরীক্ষা কেন? পুরুষের পরীক্ষায় দ্বিধা কোথায়? এমনটা তো হতেই পারে, নারীর দেহ এবং স্বাস্থ্য় (Health) সন্তানধারণের জন্য অনুকূল। আর সমস্যা পুরুষেরই? এই সমস্যা নিয়েই TV9 বাংলার সঙ্গে কথা বলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের প্রফেসর-চিকিত্‍সক তপন নস্কর।

আরও পড়ুন: কুষ্ঠি-ঠিকুজি নয়, বিয়ের আগে প্রয়োজন ডাক্তারি পরীক্ষা, মত চিকিত্‍সকের 

প্রশ্ন: সন্তানধারণে সমস্যা। মহিলাদের পরীক্ষা করানো হয় প্রথমে। পুরুষ দ্বিধাগ্রস্ত। তার অনীহা। ইগোর সমস্যা। হতেই পারে সমস্যা সেই পুরুষেরই। পরীক্ষা না করালে তো সেটা জানা যাবে না। আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

চিকিত্‍সক: অনেক স্বামী-স্ত্রীই আসেন আমাদের কাছে। এসে বলেন, তাঁদের সন্তানধারণে সমস্যা হচ্ছে। এখানে বলে রাখি, আমাদের মেডিক্যাল বইতে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, প্রথমেই স্বামীর বীর্য (Sperm) পরীক্ষা করানোর কথা। স্বামীর এই একটি পরীক্ষাতেই অনেককিছু বোঝা যায়। এই পরীক্ষা করা যায় সহজেই। খরচও কম। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও লাগে না। সেই জন্যই আমরা স্বামীর বীর্য পরীক্ষার পরামর্শ দিই। যদি রিপোর্টে গণ্ডগোল না থাকে, আমরা স্ত্রীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বলি।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: এই পরামর্শ শুনে পুরুষদের কী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন?

চিকিত্‍সক: এটা তো পুরুষশাসিত সমাজ, তাই প্রথম প্রতিক্রিয়ই হল, “আমার কোনও সমস্য়া নেই। আমি ঠিক আছি। পরীক্ষা করানোর কী দরকার। সমস্যা তো আমার স্ত্রীরই। ওরই সমস্য়া।” কিন্তু আমরা বই খুললে বুঝতে পারব, যতগুলি কারণ আছে, তার ৩০% পুরুষের বীর্য সংক্রান্ত সমস্য়া। ৩০% মহিলাদের সমস্যা। ৩০% নারী-পুরুষ উভয়ের সমস্যা। বাকি ১০% এমন কিছু সমস্যা, যেটা আমরা জানি না। ফলে, ১০০ ভাগের মধ্যে ৩০ ভাগে দায়ী পুরুষ। এটাই আমাদের বোঝাতে হবে, পুরুষের যদি কোনও সমস্য়া থাকে, সেটা কোনও দোষের নয়। সমস্য়া যে কারও হতে পারে। প্রথমেই পরীক্ষা করানো দরকার। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং (Counselling) করানো যেতে পারে।

প্রশ্ন: প্রথমেই আপনি বললেন, এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ… এখানে পুরুষকে সবসময় সর্বোচ্চ আসন দেওয়া হয়। গর্ভস্থ (Pregnant) অবস্থায় সন্তানের লিঙ্গ (Gender) জানতে ক’জন আসেন? যদিও এটা জানতে চাওয়া আমাদের দেশে বেআইনি…

চিকিত্‍সক: আসেন। যদিও সংখ্যাটা বেশি নয়। মহিলারাই লিঙ্গ জানতে বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে তাঁরা, যাঁদের আগে কন্যা সন্তান জন্মেছে। কাকুতি-মিনতি করেন। বলেন, “ডাক্তারবাবু, ছবি তো তোলালেন, কী আছে বলুন, আমি কাউকে বলব না।” আমাদের সমাজই এই সাইকোলজিক্যাল প্রেশার (Psychological Pressure) দিয়ে রেখেছে। সেই প্রেশার থেকেই এই প্রশ্ন।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: আপনি বললেন, প্রথমে পুরুষের পরীক্ষা করানোর কথা লেখা আছে ডাক্তারি বইতে। এই পরীক্ষাগুলি কী-কী?

চিকিত্‍সক: আমরা বলি, পরীক্ষার আগে দু’-তিনদিন স্বামী-স্ত্রী সহবাস করবে না। বা পুরুষ নিজে হস্তমৈথুন করবে না। তাতে পরীক্ষার ফল সঠিক আসবে। একটি শুকনো কন্টেইনার দেওয়া হয়। তাতে বীর্য (Sperm) কালেক্ট করা হয়। সেই বীর্য পরীক্ষা করেই জানা যায় সমস্যা আছে কি না।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: কী-কী দেখা হয় পরীক্ষায়?

চিকিত্‍সক: দেখা হয় শুক্রাণুর সংখ্যা কত, বীর্যের পরিমাণ কত, শুক্রাণুর প্রোগ্রেসিভ ফরওয়ার্ড মুভমেন্ট (Progressive Forward Movement) আছে কি না (সামনের দিকে এগোচ্ছে কি না), এগোলে কত পার্সেন্ট এগোচ্ছে—এগুলোই মূলত দেখা হয়।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: কত পার্সেন্টেজ থাকা বাঞ্ছনীয়?

চিকিত্‍সক: মোটামুটি এক এমএল বীর্যে ১৫ মিলিয়ান শুক্রাণু থাকতে হবে। ১০০টি শুক্রাণু খুঁজলে ৬০% নর্ম্যাল শুক্রাণু থাকতে হবে। সেগুলির মধ্যে ৩৫%-এর প্রোগ্রেসিভ ফরওয়ার্ড মুভমেন্ট থাকতে হবে। তার মধ্যে ৪% শুক্রাণুর মাথা, লেজ স্বাভাবিক কিনা দেখতে হবে। বীর্যের মধ্যে ফ্রুকটোজ মাত্রা কত আছে দেখতে হবে। এগুলো যদি ঠিক থাকে, তাহলে আমরা পুরুষ ব্যক্তিকে বলি, তার আপাতত কোনও সমস্যা নেই।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: যদি এই পরীক্ষায় কোনও পুরুষ পাশ করতে না পারেন, তা হলে কোন কোন কারণকে আপনারা দায়ী করেন?

চিকিত্‍সক: অনেক কারণেই হতে পারে। এক, হতে পারে বংশগত কারণ। আর একটা হতে পারে অর্জিত কারণ। ধরুন, কোনও অস্ত্রোপচার হল। শুক্রাণু বেরনোর রাস্তাই ব্লক হয়ে গেল। বা এমন কোনও জন্মগত ত্রুটি—যেখানে শুক্রাণু তৈরিই হচ্ছে না, কম পরিমাণে তৈরি হচ্ছে বা বিকৃতভাবে তৈরি হচ্ছে। অনেকসময় হরমোনের সমস্য়া (Hormonal Problems) থাকতে পারে। ছোটবেলায় মামস্ অর্কাইটিস হলে সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন: মামস্ অর্কাইটিস তো গলায় হয়? শুক্রাণুতে কীভাবে এর প্রভাব পড়ে?

চিকিত্‍সক: আসলে মামস্ অর্কাইটিস হলে ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে টেস্টিসে। তখন টেস্টিসে শুক্রাণু তৈরি করার ক্ষমতা কমে যায়।

প্রশ্ন: এছাড়া…?

চিকিত্‍সক: অনেকসময় আগুনের কাছে বেশি কাজ করলে, গরমে কাজ করলে, গরমের মধ্যে ১৮-২০ ঘণ্টা আন্ডারওয়্যার পরে থাকলে স্পার্ম তৈরি করার ক্ষমতা কমে যায়।

প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন বেশি হস্তমৈথুন করলে শুক্রাণু তৈরির পরিমাণ কমে যায়? এটা কি সত্যি না মিথ?

চিকিত্‍সক: এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এটা মানুষের কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়।

প্রশ্ন: নেশা করলে ইনফার্টিলিটি হতে পারে?

চিকিত্‍সক: হ্যাঁ। নেশা করলে সমস্যা হতে পারে। খুব বেশি পরিমাণে মদ্য়পান করলে, শুক্রাণুর মান খারাপ হয়ে যেতে পারে।

নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: এই সমস্যাগুলো থেকে বেরনোর রাস্তা কী?

চিকিত্‍সক: প্রথমেই কারণ খুঁজতে হবে যে কেন হচ্ছে। অনেকসময় ইমপোটেন্সি (Impotency) আসে, অর্থাত্‍ পুরুষাঙ্গ শক্ত হয় না। সেটা ডায়াবিটিস (Diabetes) থাকলে হতে পারে। নার্ভের সমস্যা থাকলে হতে পারে। মানসিক ভীতি থেকেও হতে পারে। এগুলোর চিকিত্‍সা আছে। কিছু মেডিসিন আছে। কারও শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে, ওষুধ খাইয়ে বাড়ানো যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের পর শুক্রাণু বেরনোর রাস্তা আটকে গেলে, সেটাও ঠিক করা যেতে পারে। হরমোনের সমস্যা থাকলে সেটাও ঠিক করা যায়। আবার অনেকক্ষেত্রে সমস্যা মেটেও না—যেমন, কারওর যদি জন্মগত ত্রুটি থাকে, যদি শুক্রাণু তৈরিই না হয়, সেটা ঠিক করা যায় না।

প্রশ্ন: সেক্ষেত্রে কী করণীয়?

চিকিত্‍সক: বাইরে থেকে অন্য কারওর শুক্রাণু কিনে স্ত্রীর গর্ভে সঞ্চার করতে হবে। সেই পদ্ধতিগুলির নাম ইনভিট্রোফার্টিলাইজেশন (IVF), ইনট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন। এর জন্য প্রয়োজন ডোনারের।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
Next Article