In Depth on Aravalli Hills: বিপদে আরাবল্লী, দিল্লি মরুভূমি হয়ে যাবে?
In Depth on Aravalli Hills: এই পর্বতশৃঙ্গ থর মরুভূমিকে পূর্ব দিকে এগিয়ে আসতে বাধা দেয়। দিল্লি ও এনসিআরের মানুষ যেটুকু শ্বাস নিতে পারেন, তাও অসম্ভব হয়ে যাবে। এতদিন দিল্লি-এনসিআরে বায়ুদূষণ কমাতে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে আরাবল্লী।

হিমালয়ের থেকেও ৩২০ কোটি বছর পুরনো। ৭৫০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত আরাবল্লী পর্বত ভারতের জন্য এক উপহার। এটি কোটি কোটি বছর ধরে কাজ করছে প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে। নাহলে কবেই দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ মরুভূমিতে পরিণত হত! আজ সেই আরাবল্লীই বিপন্ন। ধ্বংসের মুখে আরাবল্লী পাহাড়। সুপ্রিম কোর্টের সিলমোহরে উন্নয়নের নামে কার্যত বিপর্যয় নামতে চলেছে। রুখে দাঁড়িয়েছে পরিবেশপ্রেমী থেকে বিরোধী দলগুলি। কী বলছে সরকার?
যে পাহাড় দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকাকে এত বছর ধরে মরুভূমি হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে, সেই পাহাড়ই আজ ধ্বংসের মুখে!উন্নয়নের নামে, আইনের ফাঁক গলে, কাটা হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন পাহাড় আরাবল্লী। সম্প্রতিই কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক আরাবল্লী পর্বতের সংজ্ঞা বদল করে। বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠ নয়, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার উচু যে শৃঙ্গগুলি, সেগুলিকেই পর্বত বলে গণ্য করা হবে। সুপ্রিম কোর্টও গত ২০ নভেম্বর সেই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়।
এরপরই রাজস্থান জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পরিবেশপ্রেমী, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করেছেন। এই সিদ্ধান্ত পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে বলেই দাবি করেছেন, কারণ নতুন সংজ্ঞায় রাজস্থানের আরাবল্লী পর্বতের প্রায় ৯৩ শতাংশই বিপন্ন। ১০০ মিটারের নীচে এই পর্বতের অধিকাংশ রেঞ্জই। তথ্য অনুযায়ী, আরাবল্লীর ১.৬ লক্ষ পর্বতচূড়ার মধ্য়ে মাত্র ১০৪৮টির উচ্চতাই ১০০ মিটারের বেশি। বাকি অধিকাংশ পর্বতশৃঙ্গেরই উচ্চতা ৩০ থেকে ৮০ মিটার।
সুপ্রিম কোর্ট নতুন খননে ‘না’ বলেছে। তবে পরিবেশ মন্ত্রকের এই নতুন সংজ্ঞায় এটি আর সংরক্ষিত থাকবে না। আর আইনের এই ফাঁক গলেই আরাবল্লীতে শুরু হবে বেআইনি খনন। ২০১৮ সালেই সুপ্রিম কোর্টের নিয়োগ করা সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটির রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছিল যে রাজস্থানের আরাবল্লী পর্বতের ২৫ শতাংশ ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যেমন আলওয়ার জেলায় ১২৮টি পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে ৩১টি শৃঙ্গ খনন করা হয়েছে। সুপ্রিম সিলমোহরে এই খনি মাফিয়াদের দাপট আরও বাড়বে।
পরিবেশবিদ ও আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা ও দিল্লি জুড়ে বিস্তৃত আরাবল্লী রেঞ্জকে বাস্তুসঙ্কটপন্ন এলাকা (Ecologically Critical Area) হিসাবে ঘোষণা করা হোক। এখানে পাথর খনন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হোক।
যদি আরাবল্লী না থাকে, তাহলে কী হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাবল্লী পর্বত না থাকলে বা এতে ক্ষয় হলে উত্তর ভারতে বৃষ্টিপাতের প্যাটার্নই পরিবর্তন হয়ে যাবে। বর্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জলীয় বাষ্প পশ্চিমদিকে বয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। তখন চরম খরা দেখা দেবে রাজস্থানে। শুকিয়ে যাবে চম্বল, বানাস, সাহিবি, কসাবতী, গম্ভীরী, সোতা, মোরেলের মতো বহু নদী, যার উৎপত্তি এই আরাবল্লী থেকেই।
আরাবল্লীর আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল, এই পর্বতশৃঙ্গ থর মরুভূমিকে পূর্ব দিকে এগিয়ে আসতে বাধা দেয়। দিল্লি ও এনসিআরের মানুষ যেটুকু শ্বাস নিতে পারেন, তাও অসম্ভব হয়ে যাবে। এতদিন দিল্লি-এনসিআরে বায়ুদূষণ কমাতে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে আরাবল্লী।
এছাড়া ভূগর্ভস্থ জল ধরে রাখে আরাবল্লী। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদে যখন ভয়ঙ্কর জলসঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তখন এই আরাবল্লীই ভূগর্ভস্থ জলের জোগান দিয়েছিল। ১৯৮৫ থেক ১৯৯৫ সালের মধ্যে আলওয়ারে পাঁচটি নদী শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন আরাবল্লীর উপরে বাঁধ তৈরি করে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১ হাজার গ্রাম খরা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সহজ ভাষায় বললে, আরাবল্লী হল উত্তর ভারতের প্রাকৃতিক লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। এই রেঞ্জে ১ হাজারেরও বেশি প্রাণী, ৩৫০টিরও বেশি প্রজাতির পাখির বাস।
আরাবল্লীর উপরে কুনজর-
আরাবল্লীর উপরে নজর দীর্ঘদিনের। ১৯৭০-৮০ দশক থেকেই আরাবল্লীতে শুরু হয় ব্যাপক খনন। পাথর, মার্বেল, কোয়ার্টজ তোলার নামে পাহাড় কেটে ফেলা হয়। এর ফল? উজাড় হয়ে যায় বন, নেমে যায় জলস্তর। ধুলোঝড় ও বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০০২ ও ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দেয়- আরাবল্লীতে খনন নিষিদ্ধ। পরিবেশগত ছাড় ছাড়া কোনও কাজ হবে না আরাবল্লী রেঞ্জে। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালও একাধিকবার সতর্ক করেছে রাজ্য সরকারগুলিকে।কিন্তু ওই যে আইন থাকলেও, বাস্তবে কি তা মানা হয়েছে?
খনন বন্ধ হলেও শুরু হয় নতুন খেলা। গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদে তৈরি হতে থাকে বিলাসবহুল ফার্মহাউস, রিসর্ট, হাইওয়ে। সবচেয়ে বড় বিতর্ক শুরু হয় ২০২১-২২ সালে, যখন “আরাবল্লী পর্বতের” আইনি সংজ্ঞাই বদলানোর চেষ্টা শুরু হয়। অর্থাৎ পাহাড়কে পাহাড় না বলে, নির্মাণ বৈধ করার পথ। পরিবেশবিদদের প্রশ্ন, কীভাবে সুপ্রিম কোর্ট এই সম্মতি দিল। আরাবল্লী না থাকলে দিল্লি আরও দূষিত হবে। পানীয় জলের সংকট বাড়বে। থর মরুভূমি এগিয়ে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তন আরও গতি পাবে। এটা শুধু পরিবেশের প্রশ্ন নয়, এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। উন্নয়ন দরকার—কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়। আরাবল্লী বাঁচানো মানে উত্তর ভারতের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।
কেন্দ্রের বক্তব্য-
এবার বিতর্ক, বিক্ষোভ শুরু হতেই কেন্দ্রও ময়দানে নেমেছে। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব সুন্দরবনে এসে দাবি করেন, “আরাবল্লীর ক্ষেত্রে কোনওরকম পরিবেশগত ছাড় বা রিল্যাক্সেশন দেওয়া হয়নি। ভারতের চার রাজ্যে আরাবল্লী রয়েছে। দিল্লি, রাজস্থান, হরিয়ানা ও গুজরাট। মোট ৩৯টি জেলায় বিস্তৃত এই পর্বত। সুপ্রিম কোর্ট চারটি রাজ্যকেই বলেছে, এক এক জায়গায় আরাবল্লীর সংজ্ঞা বা ডেফিনেশন এক এক রকম হতে পারে না। সেটা এক রকমই হতে হবে।” তিনি জানান, কেন্দ্রও মনে করে আরাবল্লীতে খননের জন্য নির্দিষ্ট বিধি থাকা উচিত।
ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, এই দাবি করে তিনি বলেন, “আরাবল্লীর ১.৪৪ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ০.১৯ শতাংশ এলাকাই খনন যোগ্য। বাকি অংশ সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত। সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রেও নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, কেন্দ্র যে ভাবে ঝাড়খণ্ডের সারান্ডায় আগে মাইনিং প্ল্যান তৈরি করেছেন, তেমনই আরাবল্লীর ক্ষেত্রেও করতে হবে। সেই প্ল্যানে বিশেষজ্ঞরা রাজি হলে তবেই খননের অনুমতি মিলবে।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি, নতুন সংজ্ঞায় আরও সুরক্ষিত হল আরাবল্লী। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনতেই এই প্রস্তাব।
