নয়াদিল্লি: আমরা এখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের(এআই) যুগে ঢুকে পড়েছি। লেখালেখি থেকে স্টিল ছবি বা ভিডিয়ো বানানো। জরুরি তথ্যের খোঁজ থেকে রিপোর্ট তৈরি। আরও কতকিছু, সবই করে দিচ্ছে এআই। এবার ভারতে সেনা অভিযানেও এআই-এর ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। ইন্ডিয়ান আর্মি বেশকিছু দিন ধরেই নিজেদের বিভিন্ন ইন্টারনাল কাজে এআই ব্যবহার করছে। তবে, একদম বাস্তবের মাটিতে গ্রাউন্ড অপারেশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগ ও তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এর আগে সেভাবে শোনা যায়নি। সেটাও এবার হল।
গত সোমবার জম্মুর আখনুরে সেনা কনভয়ে থাকা একটা অ্যাম্বুল্যান্স লক্ষ্য করে গুলি চালায় জঙ্গিরা। জওয়ানরা সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেন। ২৭ ঘণ্টার এনকাউন্টারে ৩ জঙ্গি নিহত হয়। তবে কাজটা সহজ ছিল না। কারণ, জায়গাটা ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ে ঘেরা। তার মধ্যে জঙ্গিরা গা ঢাকা দেয়। আর ঘনঘন জায়গা পরিবর্তন করতে থাকে। গুলি চালাতে থাকে। গুলি লেগে আর্মির ট্রেনড ডগ ফ্যান্টমের মৃত্যু হয়। মেন রোড থেকে পাহাড়-জঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছনোর পথ ছিল প্রায় ৩০ ডিগ্রি খাড়াই। ফলে, গোটা অপারেশনে জওয়ানদের জীবনের ঝুঁকি ছিল। তাই জঙ্গিদের লোকেট করতে ওড়ানো হয় ড্রোন। আর নামানো হয় আর্মির উভচর যান। যা কিনা পাহাড়ি রাস্তা, জলাজমি-সহ যে কোনও টেরাইনে চলতে পারে। অপারেশনের দায়িত্বে থাকা সেনার হোয়াইট নাইট কোরের প্রধান মেজর জেনারেল সমীর শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন যে এই অভিযানে আগাগোড়া এআই-এর সাহায্য নেওয়া হয়। জানা গিয়েছে, ড্রোন, অ্যাম্ফিবিয়ান ভেহিকল, সার্চিংয়ের জন্য আর্মির অন্যান্য ডিভাইস-সবই ছিল এআই এনেবেলড। আর এই কারণেই ২৭ ঘণ্টার মধ্যে এনকাউন্টার শেষ হয়। না হলে লড়াই আরও লম্বা হত। জঙ্গিদের দেহ মেলার পর দেখা যায় তাদের কাছে ছিল অত্যাধুনিক বন্দুক ও শক্তিশালী বিস্ফোরক। ফলে, মনে করা হচ্ছে যে সম্ভবত তাদের আরও বড় কোনও নাশকতার পরিকল্পনা ছিল। সবটাই সময়মত রুখে দেওয়া গেছে এআই-এর কল্যাণে।
শীতে বরফ পড়ে কাশ্মীরের গিরিপথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তাই, প্রতি বছর শীতের আগে জঙ্গিরা জম্মু-কাশ্মীরে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। ভারতীয় সেনা জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে পঞ্চাশের বেশি জঙ্গি কাশ্মীরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের আটকাতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাচ্ছে সেনা।
দুটো দৃশ্য বা সম্ভাবনা কল্পনা করা যাক। এক, পাহাড় ঘেরা কাশ্মীরে দুর্গম এলাকায় গা-ঢাকা দিয়ে হামলা চালাচ্ছে জঙ্গিরা। কিছুতেই তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। দুই, সীমান্তে শত্রু দেশের ড্রোন ঢুকে পড়েছে। রেডারে ধরা যায়নি। এমন সব ঘটনায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়ার রূপরেখা তৈরি করছে ভারতীয় সেনা।
কীভাবে, কোন পথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ দেখা যাবে ভারতীয় সেনায়? ঠিক করতে কিছুদিন আগে সেনার ইতিহাসে প্রথমবার মুখোমুখি বসেন তিন বাহিনীর চিফ, মিলিটারি ইনটেলিজেন্স ও টেকনিক্যাল উইংয়ের প্রধানরা। সেখানে ঠিক হয় যে,সীমান্তে ক্যামেরা, ড্রোন ও রেডারের নজরদারি, ভারী আগ্নেয়াস্ত্র, সাঁজোয়া গাড়ি ও সেনা প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য খতিয়ে দেখা এবং পর্যালোচনা-এসব কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হবে। বিশেষ করে পাক-চিন সীমান্তে জোর দেওয়া হবে এআই ব্যবহারে। ইতিমধ্যেই সে কাজ শুরু হয়ে গেছে। একশোর বেশি এআই টুলস ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে ভারতীয় সেনা। সেনার লক্ষ্য মিসাইল, হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে ব্যাটল ট্যাঙ্ক এমনকি মেশিনগানেও এআই প্রযুক্তি থাকবে। তাতে এগুলোর কার্যকারিতা অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। কারণ, ডিফেন্স সেক্টরে এআই-এর ব্যবহার কতটা কার্যকর হতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছে গাজা-যুদ্ধ।
গাজা যুদ্ধের গতি বদলে দেয় এআই টুলস ‘ল্যাভেন্ডার’। ঘনবসতি এলাকায় হামাসের ঘাঁটি চিহ্নিত করে ‘ল্যাভেন্ডার’। গাজায় হামাসের টানেলেও এআই টুলসের ব্যবহার করে ইজরায়েলি সেনা। ‘গসপেল’, ‘অ্যালকেমিস্ট’ এবং ‘উইজডম’-এর মতো টুলসের ব্যবহার করে তারা। মাটির গভীরে সুড়ঙ্গ চিহ্নিত করে ‘জাইমব’ এআই টুলস।
২০২৪-এর পয়লা এপ্রিল ইয়েমেনে ইরানের দূতাবাসে মিসাইল হামলা হয়। দূতাবাসের তিনতলার ঘরে মিটিং করছিলেন ইরানি সেনার শীর্ষকর্তারা। নিখুঁত লক্ষ্যেই ঘরের জানালা দিয়ে আছড়ে পড়ে মিসাইল। ইরানের ৭ সেনাকর্তারই মৃত্যু হয়। বাকি বিল্ডিংয়ের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। এর পিছনেও এআই-য়ের কামাল বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২১ সালেই ‘অপারেশন গার্ডিয়ানস অফ দ্য ওয়াল’ লঞ্চ করেছিল ইজরায়েল। সেইসময় এআই টুলের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই গাজায় হামলা চালিয়েছিল তেল আভিভ। ইতিহাসে ওই ১১ দিনের লড়াই ইতিমধ্যেই প্রথম এআই যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
এক্ষেত্রে ভারতের পরিকল্পনাটা কী? প্রতিরক্ষামন্ত্রক সূত্রে খবর, প্রাথমিকভাবে ৫টি ক্ষেত্রে সেনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে। সীমান্তে নজরদারিতে রোবটের সাহায্য। মিসাইলের টার্গেট চিহ্নিত করতে এআই প্রযুক্তি। প্রতিকূল এলাকায় রসদ পৌঁছতে ড্রোনে এআই টুলস। শত্রুর ড্রোন ও জৈব অস্ত্রের হামলা রুখতে প্রযুক্তি। এবং বিমানে অস্ত্র ও মিসাইল লোড করার পরিকাঠামো।
প্রতিরক্ষামন্ত্রক সূত্রে খবর, বহু এআই টুলস ভারতেই তৈরি হচ্ছে। কিছু প্রযুক্তি আমদানির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। সব দেখে শুনে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুটা দেরি হলেও অবশেষে প্রয়োজনীয় কাজটা শুরু হল ভারতীয় সেনায়।