India Bangladesh: জানেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ভারতের কোষাগার থেকে কত টাকা খরচ হয়েছে?
শুধু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই নয়, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে ও তারপরেও অকাতরে অর্থ বিলিয়ে গেছে ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র কিনতে বা স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে যত টাকা দিয়েছে ভারত, বিশ্বের ইতিহাসে তেমন কোনও নজির নেই। কোনও দেশ, কোনওদিন অন্য কোনও দেশকে এত টাকা অর্থ সাহায্য করেনি

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বিকেল ৪টে বেজে ৩১ মিনিট। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি বিনা শর্তে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বাধ্য হলেন ভারতের পরাক্রমের সামনে। ঢাকায় বসে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর ইস্টার্ন ফ্রন্টের জেনারেল অফিসার কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা ভারতীয় সেনার জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার সামনে আত্মসমপর্ণ করল ৯৩ হাজার পাক সেনা। বিশ্বের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় আত্মসমপর্ণের নজির নেই। পূর্ণতা পেল শেখ মুজিবের ‘জয় বাংলা’ আন্দোলন। ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পিছু হটল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, টানা ২৩ বছরের পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে গঠিত হল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
এই পর্যন্ত ইতিহাস অনেকেরই জানা। এও অনেকেই দেখেছেন বা পড়েছেন , যে কীভাবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বে ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেক’ শ-এর সুযোগ্য নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদাতিক, বায়ু ও নৌবিভাগ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল পরাধীনতার যন্ত্রণা ভুলে মুক্তির আস্বাদ পেতে। কিন্তু এটা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন, যে শুধু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই নয়, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে ও তারপরেও অকাতরে অর্থ বিলিয়ে গেছে ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র কিনতে বা স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে যত টাকা দিয়েছে ভারত, বিশ্বের ইতিহাসে তেমন কোনও নজির নেই। কোনও দেশ, কোনওদিন অন্য কোনও দেশকে এত টাকা অর্থ সাহায্য করেনি।
প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের খরচের হিসাবের দিকে নজর রাখি। ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সেনার জন্য আর্থিক সাহায্য, প্রশিক্ষণ ও খাদ্যসামগ্রীর জন্য ১৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে তৎকালীন হিসাবে। যার মধ্যে বেশিরভাগটাই করা হয়েছিল নগদে। তৎকালীন হিসাবে আরও অন্তত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলাররের অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো হয় বাংলাদেশের প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর জন্য।
এবার শরণার্থী সমস্যার জন্য ভারতের খরচের হিসাবে আসি। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মোতাবেক, মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) থেকে ঘরছাড়া হন অন্তত ৩ কোটি মানুষ। সেই ১০ মাসে তাঁদের মধ্যে অন্তত ১ কোটি শরণার্থী ভারতে এসে আশ্রয় নেয়। কারা ছিলেন না সেই তালিকায়? সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবার, সেনা অফিসার, পুলিশ, পুরোহিত, শিক্ষক, শিল্পী! শুরুতে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার, শেষের দিকে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার উদ্বাস্তু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় পেতে চলে আসেন। ভারত তাঁদের খাবার, আশ্রয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে। শরণার্থী চাপে কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও রদবদল আনতে হয়। ১৯৭১-৭২-এর আর্থিক বাজেটে আলোচনাও হয়, কীভাবে সীমান্তপারের অশান্তির প্রত্যক্ষ প্রভাব এ দেশের সম্পদের উপর পড়ছে।
বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে ১৯৭২-এর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি শরণার্থীকে খাদ্য ও আশ্রয় দিতে ভারতের খরচ হয় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূল্যবৃদ্ধি মেনে আজকের দিনে ওই অর্থের পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকায় হিসাব করলে ৪,৭১,১৬,৮৩,৫২,০৫০.০০ টাকা বা প্রায় ৪৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। যে টাকার পুরোটাই ভারত নিজের ভাঁড়ার থেকে খরচ করেছিল। ২০১০ সালে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোয়েন্দাদের নথি থেকে জানা যায়, ১৯৭১ আর্থিক বছরে কেন্দ্রকে শরণার্থীদের জন্য দেশের মোট খরচের ৪ শতাংশ খরচ করতে হয়েছিল। আসাম, ত্রিপুরা ও এ রাজ্যে অন্তত ৩৩৫টি ক্যাম্প তৈরি করে কেন্দ্র। হাজার হাজার স্কুল, বহুতল, ট্রেনিং ইন্সটিটিউটকে রাতারাতি ত্রাণ শিবিরে বদলে ফেলা হয়। এগিয়ে আসে রাজ্যগুলিও। রাজস্থান সরকারের আর্থিক অনুকূল্যে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরায় ১ হাজার শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি হয়। যার মধ্যে ৪০০টি করে আসন ভ্রাম্যমাণ সুবিধাযুক্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের নথি বলছে, ১৯৭১-এর ২৪ মে লোকসভায় দাঁড়িয়ে শ্রীমতি গান্ধী বলেন, “শুধুমাত্র ত্রাণ বাবদ কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে ৬ মাসে ১৮০ কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে।” মনে রাখতেই হবে এই হিসাব ১৯৭১ সালের। ভারত সেদিন দেখেনি, ওপার থেকে যাঁরা আসছে, তাঁরা হিন্দু না মুসলিম নাকি খ্রিস্টান। সকলকে নিজের দেশে আশ্রয় দেয় পরম মমতায়। আফশোসের বিষয়, ভারত সেদিন যেভাবে এই শরণার্থী সমস্যা সামলেছিল, সেটাকে আজও বিশ্বের ইতিহাসে সেভাবে জায়গা দেওয়া হয়নি। মিডিয়া ও এনজিওগুলি সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও কিন্তু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা বন্ধ করেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে পরিকাঠামো গড়ে দিতেও সাহায্যের হাত বাড়ায় ভারত। মার্কিন গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশকে ১৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্য করে ভারত। যার মধ্যে ৩২ মিলিয়ন ডলার নগদে সাহায্য করা হয়। পরে ঢাকাকে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের শিশুদের দুধ, চিনি, নুন ও ওষুধ পাঠায় দিল্লি। আজকের দিনে হিসাবে টাকায় অঙ্কটা ১১,২৪৪ কোটি টাকা। ১৯৭২-এর জুনে বাংলাদেশকে পূর্ব আশ্বাস মাফিক মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ সাহায্য করা হয়। কত টাকা/ সেই তথ্য অবশ্য কেন্দ্র প্রকাশ করেনি। আর শুধু নগদ অর্থ নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে প্রচুর খাদ্যসামগ্রীও পাঠায় দিল্লি। সে দেশের ব্যাঙ্কগুলিকে স্বনির্ভর হতে সফট লোন দেয় ভারত। আর ভারতের সৌজন্যে বিশ্বের অন্তত ৯৫টি দেশ বাংলাদেশের অস্তিত্ব জানতে পেরে সদ্য গঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে গড়ে তুলতে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ধাপে ধাপে ঘরছাড়াদের বাংলাদেশে ফিরতেও সাহায্য করে দিল্লি। ২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিশ্রুতিকরণের জন্য অন্তত ৫০০টি কুইক ইম্প্যাক্ট প্রজেক্টে অর্থ সাহায্য করে ভারত। এক একটি প্রজেক্টের মূল্য ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। কোভিড ১৯-এর সময়েও বাংলাদেশকে ওষুধ, মাস্ক, ভ্যাকসিন পাঠায় দিল্লি।
১৯৭১ থেকে টানা আজ পর্যতো একদিনের জন্যও বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা থামায়নি দিল্লি। বাংলাদেশের ইকোনমিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টের তথ্য বলছে, গত ৫২ বছর ধরে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ মোট ১২২.৪৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য পেয়েছে। যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ২০১০-এ পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও জঙ্গিদমনের জন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের LOC বা লাইন অফ ক্রেডিট, ২০১৭-য় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বাংলাদেশ সফরে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের LOC ঢাকাকে প্রদান করেন। ২০১৬ থেকে রাস্তা, রেলপথ, বন্দর নির্মাণের জন্য ভারত অন্তত ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়ে আসছে। যার মধ্যে রয়েছে খুলনা-মঙ্গলা বন্দর রেল লাইন, আখাউরা-আগরতলা রেল লিঙ্ক অন্যতম। এমনকী, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে শেখ হাসিনা জমানার পরবর্তীতেও বাংলাদেশকে ১২০ কোটি টাকার বার্ষিক আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছে ভারত। সবমিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ভারত খরচ করেছে প্রায় ৬.৫ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলায় আর ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন লাইন অফ ক্রেডিটের জন্য। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে সংখ্যাটা ৫,৯৯,২৬,৩০,০০,০০০ টাকা। তবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সাহায্যকে শুধু টাকার অঙ্কে দেখলে চলবে না, কারণ দেশটির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে একটি সদ্য গঠিত রাষ্ট্রর ভিত– পুরোটাই ভারতের সাহায্যে গড়া। আজ অবশ্য চিন, আমেরিকা, জাপান ও বিশ্ব ব্যাঙ্কও বাংলাদেশকে গভীরভাবে আর্থিক সাহায্য করে।





