নয়া দিল্লি: মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee) লেখা শেষ বই ‘দ্য প্রেসিডেনসিয়াল ইয়ার্স’ (The Presidential Years)। ৪৮ ঘণ্টাও কাটল না, ‘বেস্ট সেলার’ তকমার সঙ্গেই রূপা পাবলিকেশন প্রকাশিত প্রণববাবুর জীবনস্মৃতি এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতেও। ২৮০ পাতার এই বই বুধবার থেকেই সংবাদ শিরোনামে। আর তা হওয়ার পিছনে রয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লিখে যাওয়া রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং ঘটনাবলীর ‘ময়নাতদন্ত’।
পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং নিঃসন্দেহে ভাল কাজ করেছেন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন করেননি। কংগ্রেস হাইকমান্ড সোনিয়া গান্ধী ডঃ মনমোহনকে (Manmohan Singh) এই পদের জন্য মনোনিত করেছিলেন। অন্যদিকে ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব’ অর্জন করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বইয়ে এই বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি দিয়ে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
‘নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন করেছেন’
এক সময় ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’ বলা হত যাঁকে, সেই প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর জীবনস্মৃতি লেখা বইয়ের ১৭২ পাতায় লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি (ডঃ মনমোহন সিং) ভাল কাজ করেছেন ঠিকই। তবে ২০১৪ সালে বিজেপির ঐতিহাসিক জয়ের পর বিপুল জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন করেন নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi)। তিনি মনেপ্রাণে একজন রাজনীতিক এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করেই বিজেপি নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিল। সে সময় তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং মানুষের কাছে সেই ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন করেছেন নরেন্দ্র মোদী।”
‘প্রধানমন্ত্রী পদে কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রথম পছন্দ ছিলেন সোনিয়া গান্ধী’
মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে প্রণববাবু পরিষ্কার করে লিখে গিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুই প্রধানমন্ত্রীর পথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ডঃ মনমোহন সিংকে প্রস্তাব দেন সোনিয়া গান্ধী।”
একই সঙ্গে সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী না হওয়া নিয়েও কংগ্রেসি রাজনীতির বিশ্লেষণ রয়েছে প্রণববাবুর লেখা ‘দ্য প্রেসিডেনসিয়াল ইয়ার্স’-বইয়ে। তিনি লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রথম পছন্দ ছিল সোনিয়া গান্ধী (Sonia Gandhi)। ইউপিএ-র আরও শরিকরাও তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।”
‘২০১৪ সালে নির্ণায়ক জনাদেশ আসা ছিল বিরাট স্বস্তির’
প্রণববাবু ভেবেছিলেন ২০১৪ সালের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল হবে ‘ত্রিশঙ্কু’। আর সেটা হলে সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে একটি স্থায়ী সরকার দেওয়াই হত তাঁর কাজ। বইতে প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “অতীতে কংগ্রেস অল্প আসন নিয়েও ক্ষমতায় থেকেছে। সেই ইতিহাসকে পাথেয় করেই আমি সরকারি দলের সংসদীয় নেতাকে ডেকে পাঠাতাম এবং জোট সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতাম।” তবে সেটা না হয়ে কোনও একটি দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসায় ‘গুরু’ দায়িত্ব থেকে নিস্তার পেয়েছেন প্রণববাবু। তিনি সে কথা স্বীকারও করেছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজের শেষ লেখা বইয়ে লিখে গিয়েছেন, “নির্ণায়ক জনাদেশ আসায় আমি অনেকটা স্বস্তি পেয়েছি।”
একই সঙ্গে কংগ্রেসের নৌকাডুবিতে নিজের হতাশার কথাও ব্যক্ত করেছেন তিনি। ‘দ্য প্রেসিডেনসিয়াল ইয়ার্স’-এর ২০ এবং ২১ পাতায় সরাসরি সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন দেশের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি। সঙ্কটকালীন সময়ে চেনা পথের বাইরে গিয়ে হাঁটতে হয়। হাইকমান্ড তা করেনি। সেকারণেই কেন্দ্র ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যেও হারের সম্মুখীন হয়েছে দেশের আদি রাজনৈতিক দল। এর পিছনে রয়েছে নেতৃত্ব বাছাইয়ে ভুল করা এবং শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ত্রুটি। উদাহরণ স্বরূপ, মহারাষ্ট্রে বিলাসরাও দেশমুখের পর সেভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন না করা এবং ইউপিএ থেকে তৃণমূলের চলে যাওয়া-কে অন্যতম ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রণব। তাঁর ‘আক্ষেপ’, রাষ্ট্রপতি না হলে সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতেন এবং দলকে এই ভরাডুবি থেকে নিশ্চিত রক্ষা করতেন তিনি।
‘মোদীর লাহোরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না’
এই বইতেই মোদীর বিদেশ নীতির প্রশংসা করেন প্রণব। তাঁর কথায়, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক গোষ্ঠীভূক্ত দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে চমক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এরপর যেভাবে উহান সফরে গিয়ে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার পথে হেঁটেছেন, সেটাও ছিল নরেন্দ্র মোদীর চমক। অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীরা এর আগে এভাবে ভাবেননি।
তবে পাকিস্তানে গিয়ে লাহোরে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলেও পারতেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেকথাও অবলীলায় লিখে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।