
নয়াদিল্লি: ইয়েস স্যার, নো স্যার, উই অপোজ স্য়ার! বাদল অধিবেশন টেনেছে ইতি। গত ২১ জুলাই থেকে একেবারে ২১ অগস্ট। টানা এক মাস সংসদে চলেছে বাদল অধিবেশন। ধনখড়ের ইস্তফা, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে দু’দিনের বিশেষ অধিবেশন, SIR নিয়ে মৌনতা ও সবশেষে মন্ত্রিত্ব বাতিল বিল ঘিরে শাহের দিকে কাগজ ছুড়ে দেওয়া। স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জনগণ, স্বাধীন নেতা-নেত্রী, তাই স্বাধীন সময়ও। কিন্তু এই সময় জনগণের জন্য কি স্বাধীন? বাদল অধিবেশন যেন সেই প্রশ্নটাই আবার তুলে দিয়ে গেল।
ধরা যাক, একজন সাধারণ মানুষ, চাকুরিজীবী। এই ভূভারতের প্রতিটি স্তরে যার জন্য বাঁধা রয়েছে কর-শৃঙ্খলা। তিনি প্রতিদিন চাকরি করতে যান। শ্রম আইন মেনে ৮ ঘণ্টা কাজ করেন। কখনও শ্রম আইন চ্যুত হয়, ৮ ঘণ্টা ৯, ১০, ১১, কখনও ১২ ঘণ্টায় পরিণত হয়। তিনি হারেন না, করে যান। কারণ, এটাই তার ‘করণীয়’, এটাই তার ‘কর্ম’, যা তাকে ‘ফল’ দেবে। আর সেই ‘ফলের’ জন্য তাকে ভুলে যেতে হয় ‘সময়ের স্বাধীনতা’।
এই ‘বিলাসিতা’ সাধারণের নেই। কিন্তু এই সাধারণ যাকে জনপ্রতিনিধি করে পাঠাচ্ছেন, তার কি রয়েছে? অর্থাৎ একজন বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী। তাদের কাছে কি সেই স্বাধীনতা রয়েছে? তাই নিয়েই এবার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ। চলতি বছরের বাদল অধিবেশনে কতক্ষণ চলল সংসদ? কতক্ষণ মুলতুবি থাকল? কতক্ষণই বা জনতার কথা ভাবল?
সময়ের খসড়া
রিপোর্ট বলছে, চলতি অধিবেশনে লোকসভা কাজ করেছে তার নির্ধারিত সময়ের ২৯ শতাংশ এবং রাজ্যসভা করেছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। বেশ কয়েকটা বিলও পাশ হয়েছে। অনলাইন গেমিং বিল, তা তো আবার আইনে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ১৮ তম লোকসভার নিরিখে এই শতাংশের হিসাব একেবারে সর্বনিম্ন।
গত বাজেট অধিবেশনে নির্ধারিত সময়ের ১১১ শতাংশ কাজ চলেছিল লোকসভায়, সেখানে রাজ্য়সভায় চলেছিল ১১২ শতাংশ। অর্থাৎ বাড়তি সময় আলোচনা করেছিলেন সাংসদ, মন্ত্রীরা। একই ভাবে গত শীতকালীন অধিবেশনে লোকসভা চলেছিল ৫২ শতাংশ এবং রাজ্যসভা চলেছিল মাত্র ৩৯ শতাংশ।
শুধু তা-ই নয়! তুলে ধরা রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা বাদল অধিবেশনে মিনিট খানেকের জন্যই লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্ব চলেছে। আর বেশির ভাগ সময় সংসদ থেকেছে মুলতুবি। এই প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, বিরোধী সাংসদরা যতবারই মৌখিক ভাবে শাসক শিবিরকে কোনও প্রশ্ন করেছেন, তার প্রত্যুত্তর পেতেও বেশ হোঁচট খেতে হয়েছে তাদের। তথ্য অনুযায়ী, মোট ২১ দিনের মধ্য়ে ১২ দিন রাজ্যসভায় ও ৭ দিন লোকসভায় কোনও প্রশ্নের মৌখিক ভাবে উত্তর পেয়েছেন বিরোধীরা।
সময়ের এই ‘মারপ্যাঁচ’ ধরা পড়েছিল অধিবেশনের প্রথম দশ দিনেই। ২১ তারিখ থেকে সংসদে বাদল অধিবেশন শুরু হয়েছিল। শনি-রবি বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে অধিবেশন চলার কথা। যার মধ্য়ে এক ঘণ্টা আবার ‘লাঞ্চ টাইম’। অর্থাৎ প্রথম দিনের মধ্যে হাতে রইল ৮ দিন। যার মধ্য়ে দুই কক্ষে এক দিন করে চলেছে ১৬ ঘণ্টার অধিবেশন। কিন্তু এই ৮ দিনের মোট কতদিন মুলতুবি ছাড়া সংসদ চলল? দু’টি কক্ষ মিলিয়ে হিসাব দাঁড়াচ্ছে প্রায় আড়াই দিন। আর বাকি সাড়ে পাঁচ দিন কী হল? চলল প্রতিবাদ। অধিবেশন হল মুলতুবি।
বিলের খসড়া
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গোটা বাদল অধিবেশন সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়েছে মোট ১৫টি বিল। জেপিসি কমিটির কাছে বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে মোট তিনটি বিল। বুধবার লোকসভায় পেশ হওয়া ১৩০ তম সংবিধান সংশোধনী বিল, জম্মু ও কাশ্মীর রিঅর্গানাজেশন বিল, গভার্নমেন্ট অব ইউনিয়ন টেরিটোরি বিলকে একেবারে খারিজ করে দেয় বিরোধী শিবির। চলে ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মুলতুবি হয়ে যায় সংসদ। বিবেচনার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয় এই বিতর্কিত ‘ত্রয়ীকে’। জয়েন্ট কমিটির পাশাপাশি লোকসভার সিলেক্ট কমিটির কাছে আরও দু’টি বিল বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছেন অধ্যক্ষ।
তবে কত বিল পাশ হল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ সেই বিল নিয়ে কতক্ষণ আলোচনা হল। এই যেমন নয়া আয়কর বিল। লোকসভায় এই বিলের জন্য ১২ ঘণ্টা নির্ধারিত ছিল, কিন্তু আলোচনা হল মাত্র ৫ মিনিট। তারপর তা পাশ হয়ে গেল। একই অভিযোগ তোলা হয়েছিল অনলাইন গেমিং বিলের (যা বর্তমানে আইন) ক্ষেত্রেও।
কোন আলোচনায় সবচেয়ে বেশি সময় গেল?
সরকারি ভাবে প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি অধিবেশনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’। ২৮ ও ২৯ জুলাই লোকসভায় ৭৩ জন সদস্য মোট ১৮ ঘণ্টা এই নিয়ে আলোচনা চালিয়েছেন। অন্যদিকে ২৯ ও ৩০ জুলাই রাজ্যসভায় এই নিয়ে আলোচনা চলেছে ১৬ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। আরও একটি পরিসংখ্য়ান বলছে, লোকসভায় আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে ৫০ শতাংশ ছিল অপারেশন সিঁদুর ও পহেলগাঁও সন্ত্রাস হামলা। রাজ্যসভায় নির্ধারিত সময়ের ৩৪ শতাংশ সময়ও আলোচনার অভিমুখ থেকেছে এই সিঁদুরেই। SIR নিয়ে আলোচনা হয়নি বললেই চলে।