
নয়াদিল্লি: বৃহস্পতিবার লোকসভা এবং রাজ্যসভায় একযোগে পাশ হয়ে গেল বিকশিত ভারত-গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন বিল। সংক্ষেপে ‘জিরামজি’। বিরোধ-বিক্ষোভ সবটাই পেরিয়ে আইন হওয়ার পথে মোদী সরকারের নয়া বিল। কিন্তু এই নিয়ে এত বিতর্ক কেন? গরিবদের জন্য কাজের দিন বাড়ছে, কিন্তু বিরোধীরা ফুঁসছে। মনরেগা নাকি অস্তিত্ব হারাচ্ছে! রাজনীতির অঙ্কটা কোন নিয়মে কষা চলছে?
মঙ্গলবার এই বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রের কৃষি এবং গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। তারপরই লোকসভায় শুরু হয় শোরগোল। হাতে গান্ধীর ছবি নিয়ে ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান বিরোধী সাংসদদের একাংশ। বিক্ষোভ দেখা যায় সংসদের মকর দ্বারেও। অভিযোগ ওঠে ‘মনরেগা’ প্রকল্পের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার। কিন্তু মোদীর সরকারের এই নয়া বিলের সঙ্গে ‘মনরেগা’ প্রকল্পের কী যোগ? চলুন বিষয়টি নিয়ে কাটাছেঁড়া করা যাক।
দশক ধরে গ্রামীণ নাগরিকদের রোজগার প্রদান করছে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট বা মনরেগা। চলতি ভাষায় ১০০ দিনের কাজ। কিন্তু সেই ১০০ দিনের কাজে এবার বদল আনতে চায় কেন্দ্র। ‘মনরেগা’ আইনে সংশোধন, মোদী সরকার প্রস্তাব দিয়েছে নতুন আইন তৈরির জন্য়। সেই মর্মেই এই নয়া বিল।
ঠিক কী কী বলা হয়েছে এই বিলে? কোথায় গিয়ে ‘মনরেগা’র থেকে আলাদা এটি?
এই প্রস্তাবিত বিলের ধারা ৫-এর ১ বলা হয়েছে, মনরেগার মতো ১০০ দিন নয়। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের উপভোক্তাদের দেওয়া হবে ন্যূনতম ১২৫ দিনের কাজের গ্য়ারান্টি। তবে বেশ তফশিলি উপজাতি ভুক্ত নাগরিকরা, যাঁরা বনাঞ্চলে থাকেন, তাঁদের ন্যূনতম ১৫০ দিন কাজের গ্যারান্টি দিয়েছে কেন্দ্র। এই বিলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের সুবিধার্থে ফসল কাটার মরসুমে ৬০ দিনের ছাড় দেওয়া হবে। বাকি ৩০৫ দিনের মধ্যে পূর্ণ হবে ১২৫ দিন কাজের গ্যারান্টি।
স্বাভাবিক ভাবেই কাজের দিন বাড়লে আয় বাড়বে, কিন্তু তারপরেও এই নয়া বিলে সন্তুষ্ট নন বিরোধীরা। এই যেমন প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর মতে, কাজের দিন বাড়ছে, মজুরি বাড়ছে না। সবটাই লোক দেখানো।
শুধুই কাজের দিন নয়, রোজগারকেও সুনিশ্চিত করেছে কেন্দ্র। বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকেই ১০০ দিনের কাজে বকেয়া না মেটানোর অভিযোগ উঠে থাকে। তৃণমূলের মতে, বাংলার বকেয়ার পরিমাণ লক্ষ কোটি টাকা পৌঁছে গিয়েছে। এই নয়া বিলে উপভোক্তাদের কাছে দ্রুত টাকা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্র। মনরেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেওয়া হত ১৫ দিনের কাজের পর। কিন্তু এই নতুন বিলে সেই চুক্তি রাখছে না কেন্দ্র। বরং প্রতি সপ্তাহের টাকা, প্রতি সপ্তাহে মিটিয়ে দেওয়ার কথাই বিলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
এই বিল প্রসঙ্গে দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথম গান্ধীর নাম নিয়ে বিতর্ক। দ্বিতীয় অনুদানের অংশীদারিত্ব। প্রথমে নামের কথায় আসা যাক। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে প্রিয়ঙ্কা হোক বা কলকাতায় মমতা। মোদী সরকারের ‘জিরামজি’ বিল নিয়ে সরব বিরোধীরা। জাতির জনকের নাম ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেই অভিযোগ তাঁদের। এদিনই কেন্দ্রকে নিশানা করে মমতা বললেন, ‘জাতির জনককে ভুলে যাচ্ছেন? ভাবা যায়!’ একই অভিযোগ প্রিয়ঙ্কারও, সুর চরমে রেখেছেন মহুয়াও। তবে এই নাম নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ মানতে চায় না গেরুয়া শিবির। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, ‘তাঁরা গান্ধীজির পথেই চলছেন।’
এত গেল নামের বিতর্ক। তবে গোটা বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। অনুদানের অংশীদারিত্ব নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে বিরোধীদের মনে। মনরেগা প্রকল্পের জন্য কেন্দ্র ১০০ শতাংশ বা সম্পূর্ণ অনুদান পাঠাত। কিন্তু এই ‘জিরামজি’ বিলের ক্ষেত্রে তা হবে না। এই বিলের ২২ নং ধারায় বলা হয়েছে, উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি রাজ্য, হিমালয় সংলগ্ন রাজ্য এবং কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে ৯০:১০ অনুপাতে কেন্দ্র টাকা পাঠাবে। বাকি সকল রাজ্যগুলির সঙ্গে ৬০:৪০ অনুপাতে দেওয়া হবে অনুদান। অর্থাৎ কেন্দ্র পাঠাবে ৬০ শতাংশ টাকা, রাজ্য দেবে ৪০ শতাংশ টাকা। কংগ্রেসের মতে, এর মাধ্যমে রাজ্যগুলির উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে কেন্দ্র। অনুদানের বিতরণ নিয়ে বৈষম্য দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি, কেন্দ্র অধিকার আইনকে সরিয়ে একছত্র আধিপত্য তৈরি করছে বলেও উঠছে অভিযোগ।
দোরগোড়ায় নির্বাচন। আর এই আবহে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফের বাঙালি অস্মিতাকেই হাতিয়ার করেছে রাজ্য়ের শাসক শিবির। সম্প্রতি ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে আলোচনার সময় রবি ঠাকুরের কথা তুলে ধরেছিলেন তৃণমূল সাংসদরা। মনরেগার ‘অস্তিত্ব’ যখন সঙ্কটের মুখে, সেই আবহে আবারও রবি ঠাকুরকেই তুলে ধরল তৃণমূল। মহুয়া মৈত্রের দাবি, গান্ধীজি নামের সঙ্গে ‘মহাত্মা’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগ করেছিলেন। তাই মনরেগাকে মুছে দেওয়ার মাধ্যমে আসলে কবিগুরুকেই ‘অপমান’ করছে কেন্দ্র।
শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার মনরেগা ও গান্ধী নাম মুছে দেওয়ার এই বিতর্কে বিজেপিকে পেরিয়ে আবারও গোল দিয়েছে রাজ্য়ে শাসক শিবির। কলকাতার বিজনেস কনক্লেভ থেকে রাজ্য়ের কর্মশ্রী প্রকল্পের নাম বদলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গান্ধীর নামে কর্মশ্রী করা হবে বলেই ঘোষণা করে দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে মেরুর একদিকে মনরেগা, অন্যদিকে জিরামজি। যা ঘিরে তরজা তুঙ্গে। সামনেই বাংলার নির্বাচন, এই বিতর্ককেই কতটা কাজে লাগায় তৃণমূল, কতটা প্রতিরোধ করতে পারে বিজেপি, সেটাই এখন দেখার বিষয়।