কলকাতা: ডাক্তারির উচ্চশিক্ষায় ফের কেলেঙ্কারির ইঙ্গিত। নিট-পিজি ঘিরে বাংলায় সক্রিয় দুর্নীতির চক্র? মোটা টাকার বিনিময়ে বিকোচ্ছে ডাক্তারির স্নাতকোত্তরের আসন? কীভাবে নিট-পিজি প্রার্থীদের কাছে পৌঁছচ্ছে দুর্নীতি চক্রের মাথারা? কীভাবে টোপ দেওয়া হচ্ছে প্রার্থীদের? কত টাকায় বিকোচ্ছে মেডিসিন, স্ত্রীরোগ, সার্জারি, ইএনটি’র আসন? টিভি নাইনের হাতে লেনদেনের বিস্ফোরক অডিয়ো ক্লিপ। গত মঙ্গলবার বর্ধমানের এক নিট-পিজি পরীক্ষার্থীকে ফোন করে টাকার বিনিময়ে আসন কেনার প্রস্তাব দেয় দুর্নীতি চক্রের সদস্যরা। ফোনের সেই অডিয়ো ক্লিপ শুনলে চমকে উঠবেন। দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে বর্ধমানের মেমারি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই নিট-পিজি প্রার্থী। অডিয়ো ক্লিপের ভিত্তিতে তদন্ত চেয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে চিঠি দিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন।
ভাইরাল সেই অডিয়ো ক্লিপে কী বলা হয়েছে-
এজেন্ট: হ্যালো, নমস্কার…
নিট পিজি পরীক্ষার্থী: একটু আগে কল করেছিলেন। কী বলছিলেন, একটু বলবেন।
এজেন্ট: আমাদের পক্ষ থেকে মার্কস ম্যানুপুলেশন করা হচ্ছে। আপনার রাজ্য কি পশ্চিমবঙ্গ?
পরীক্ষার্থী: হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গ।
এজেন্ট: জেলা?
পরীক্ষার্থী: জেলা, বর্ধমান।
এজেন্ট: আমাদের পক্ষ থেকে মার্কস ম্যানুপুলেশন করা হচ্ছে। আপনার যে বিষয় পছন্দ সেখানে কাট অব মার্কস বাড়িয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে পছন্দ মতো পিজি সিট পেয়ে যাবেন।
পরীক্ষার্থী: কী ভাবে সেটা হবে বলবেন?
এজেন্ট: আপনি কোন সেন্টার থেকে পিজি করতে চান সেটা বলতে হবে। এরপর ধরুন ২০০ নম্বরের পরীক্ষা। এই ২০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বর ব্ল্যাঙ্ক ছেড়ে আসবেন। বাকি ১০০ নম্বরের যে উত্তর সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত তারই উত্তর দেবেন। কোনও নেগেটিভ মার্কিন করবেন না। যেখানে উত্তরপত্র স্ক্যান হবে সেখানে আমাদের লিঙ্ক আপ আছে। আপনার নম্বর আপনার কাট অব মার্কসের উপযুক্ত হয়ে যাবে। রেজাল্ট বার হওয়ার পর আপনি দেখবেন প্রয়োজনীয় নম্বর পেয়ে গিয়েছেন।
পরীক্ষার্থী: প্রশ্ন কি আগে থেকে বলে দেওয়া হবে?
এজেন্ট: প্রশ্ন আগে থেকে বলা হবে না। ২০০ নম্বরের প্রশ্নপত্র হলে ১০০ নম্বর ফাঁকা রেখে দেবেন। কিছু লিখবেন না। বাকি ১০০ নম্বরের মধ্যে যেগুলো জানেন সেগুলোরই উত্তর লিখবেন। আপনার কাট অব মার্কস অনুযায়ী নম্বর যাতে আপানি পান সে জন্য ১০০ নম্বর প্রশ্ন ব্ল্যাঙ্ক রাখার কথা বলছি।
পরীক্ষার্থী: ধরুন ১০০ নম্বরের প্রশ্ন আমি ব্ল্যাঙ্ক ছেড়ে এলাম-
এজেন্ট: ১০০ নম্বরের প্রশ্নের যে উত্তর সম্পর্কে আপনি পজিটিভ তার উত্তর দিতে হবে। ১০০ নম্বর ফাঁকা ছেড়ে আসতে হবে।
পরীক্ষার্থী: সিওরিটি কী?
এজেন্ট: নিশ্চয় আছে। আপনি এর জন্য যত টাকা দেবেন পুরোটাই অনলাইন ব্যাঙ্কিংয়ের মধ্যে দেবেন। এক টাকাও ক্যাশ নেব না। আপনি রাজি থাকলে টাকার বিষয়েও আপডেট করে দেব। কী ভাবে টাকা দেবেন? কত টাকা লাগবে। আপনার কী বিষয় পছন্দ বলবেন?
কোন আসনের কত দর:
মেডিসিন- ৯০ লক্ষ টাকা,
সার্জারি – ৯০ লক্ষ টাকা,
স্ত্রীরোগ- ৬০ লক্ষ টাকা,
রেডিওলজি- ৭০ লক্ষ টাকা,
ইএনটি- ৭০ লক্ষ টাকা।
এরকম রেট আছে ম্যাম।
পরীক্ষার্থী: রেট খুব হাই… আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
এজেন্ট: আপনার বাজেট কত?
পরীক্ষার্থী: আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। এত টাকা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
এজেন্ট: আপনাকে রেজাল্টের পর টাকা দিতে হবে।
পরীক্ষার্থী: রেজাল্টের পর?
এজেন্ট: হ্যাঁ। আপনার ডকুমেন্টস ভেরিফিকেশনের পর তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সিট বুকিং করতে হবে। ডকুমেন্টস ভেরিফিকেশনের পর আমাদের লোকেরা সবুজ সঙ্কেত দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। আমরা সব সিটের উপরে মার্কস ম্যানুপুলেশন করি না। ২০-২৫টি সিটের উপরে করি। সে জন্য আপনার কাজ করতে পারব এটা নিশ্চিত হওয়ার পর বুকিং অ্যাকাউন্ট হিসাবে ৩ লক্ষ টাকা নেব। রেজাল্ট বেরনোর পর বাকি টাকা।
পরীক্ষার্থী: আমার পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। ধন্যবাদ।
এজেন্ট: ওকে, ওকে কোনও বিষয় নয়।
এরপর ফোন কেটে দেওয়া হয়।
এভাবে পরীক্ষার্থীদের ‘টোপ’ দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন চিকিৎসক মাখনলাল সাহা। তিনি এখন এম আর বাঙুর হাসপাতালের ভিজিটিং কনসালটেন্ট। তাঁর মেয়ে এবছর নিট-পিজি পরীক্ষা দেবেন। ফোনালাপ শুনে এই চিকিৎসক বলেন, “ফোনালাপ শুনলাম। এখনও এরকম ফোন আসছে জেনে অবাক হলাম। একসময় নিট-পিজি দু’ভাবে হত। সরকারি কলেজে ভর্তির জন্য একটা পরীক্ষা। আর বেসরকারি কলেজগুলি নিজেদের মতো পরীক্ষা নিত। তবে বেসরকারি কলেজগুলিতে পরীক্ষার নামে প্রহসন হত। সেখানে মেরিট বলে কোনও বস্তু ছিল না। যাঁরা টাকা দিতেন, তাঁদের নাম উঠত। এরপর সরকার যখন নিট-পিজি চালু করেন, তখন আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। তবে এই যে ফোনালাপে শুনলাম, ব্ল্যাঙ্ক পেপার জমা দেওয়ার কথা, সেটা দিয়ে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও যদি তা হয়, তবে বুঝতে হবে বড় ব়্যাকেট কাজ করছে। ফলে এটা কতটা সত্যি বলতে পারছি না। তবে এটা যদি হয়, তাহলে সরকারি পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হবে।”
এই ফাঁদে পা না দেওয়ার কথা বললেন চিকিৎসক মাখনলাল সাহা। তিনি বলেন, “অনেকসময় টাকা নিয়ে আর কিছু করতে পারে না ওইসব ব়্যাকেট। এরকম ফোনকল অনেকে পায়। বিভিন্ন সেন্টারে অনেকে পড়াশোনা করেন। ফলে পরীক্ষার্থীদের ফোন নম্বর পাওয়া অসম্ভব নয়। এই ফোনকল নিয়ে আমার দ্বিধা আছে। পরীক্ষা ম্যানুপুলেট করা সম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস। কেউ যদি তিন লাখ টাকা দেন, তাঁর প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি আশা করব, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করবে।”