‘কন্যাসন্তান চিরকাল কন্যা হয়েই থাকে, আর পুত্রসন্তান ততদিন পর্যন্ত ‘পুত্র’ থাকে, যতদিন পুত্রবধূ ঘরে না আসে।’ সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে নির্দেশনামায় এ কথা উল্লেখ করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্র। আসলে কন্যাসন্তান তথা পরিবারের মহিলা সদস্যের লড়াই ভারতে দীর্ঘদিনের। যে বাড়িতে জন্ম, যে ভিটেতে বড় হওয়া, সেই ভিটের অধিকার পাবে না মেয়ে! ভারতীয় আইনে দীর্ঘদিন সেই সুযোগ ছিল না। কন্যাসন্তানের সম্পত্তিতে সমান অধিকার ছিল না। ২০০৫ সালে সংশোধন হয়েছে সেই নিয়ম।
ভারতে সম্পত্তির অধিকারের আইন মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা। অর্থাৎ হিন্দু পরিবারের জন্য রয়েছে ‘হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট’ বা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন। এছাড়া মুসলিম পরিবারের জন্য উত্তরাধিকারের আইন রয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল বা ‘শরিয়ত’ আইনে।
বর্তমানে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার কতটা?
আইনজীবী অরিন্দম দাস জানিয়েছেন, হিন্দু পরিবারের একটা ‘ফ্যামিলি ট্রি’ থাকে, সেই অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ হয়। ১৯৫৬ সালের ‘হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট’-এ মহিলা সদস্যদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার ছিল না। অর্থাৎ পুত্রসন্তানের মতো অধিকার ছিল না কন্যাসন্তানের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ে অনেক অভিযোগ ওঠে। ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, পরিবারের সম্পত্তিতে সমান অধিকার থাকবে কন্যারও। এরপর আইনে সংশোধনী আনা হয়।
২০০৫ সালের সংশোধনীকে কী বলা আছে?
২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে পুত্রের সঙ্গে কন্যাকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাবার সম্পত্তির ওপর তাঁর ছেলের যা অধিকার, মেয়েরও সেই একই অধিকার। কেউ যদি উইল না করে মারা যান, তাহলে তাঁর সম্পত্তি তাঁদের পুত্র ও কন্যাসন্তানের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে। জন্ম থেকেই কন্যার সেই অধিকার থাকবে। স্থাবর ও অস্থাবর দুই সম্পত্তিতেই থাকবে উত্তরাধিকার। বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, কন্যাসন্তানের অধিকার থাকবে একই।
২০০৫ সালের আগে হিন্দু যৌথ পরিবারে উত্তরাধিকারী বলতে বোঝাত পুত্র বা পৌত্র অর্থাৎ নাতি। তাঁরাই পেতেন সম্পত্তির মালিকানা। মনে করা হয়, যেহেতু একটা সময় উপার্জন শুধুমাত্র ছেলেরাই করতেন, ফলে বাড়ির কর্তার নামেই থাকত সব বিষয় আশয়। তাই সম্পত্তির মালিক কেবল পুরুষই হবে, এটাই ছিল ধারণা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণায় বদল এসেছে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এই সংশোধনী আসার আগে যদি পরিবারের কর্তার মৃত্যু হয়েও থাকে, তাহলেও এই আইনের ব্যতিক্রম হবে না।
শুধুই মেয়ে নাকি নাতনি বা বোনের মেয়েরাও পায় সম্পত্তি?
‘হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্টে উত্তরাধিকারে’র দুটি ধাপ রয়েছে। ‘ক্লাস ওয়ান’ অর্থাৎ প্রথম ধাপে যাদের কথা বলা আছে, তারা সরাসরি সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। তাঁদের অবর্তমানে সম্পত্তি যাবেন ‘ক্লাস টু’-এর হাতে।
‘ক্লাস ওয়ান’ কারা?
সম্পত্তির মালিকের পুত্র, কন্যা, বিধবা স্ত্রী, মা, নাতি (যদি পুত্রের মৃত্যু হয়ে থাকে), নাতনি (যদি পুত্রের মৃত্যু হয়ে থাকে), বিধবা পুত্রবধূ (যদি পুত্রের মৃত্যু হয়ে থাকে), প্রপৌত্র বা নাতির ছেলে (যদি ছেলে ও নাতির মৃত্যু হয়ে থাকে), প্রপৌত্রী বা নাতির মেয়ে (যদি ছেলে ও নাতির মৃত্যু হয়ে থাকে), নাতির বিধবা স্ত্রী।
ক্লাস টু-তে কারা থাকে?
সম্পত্তির মালিকের বাবা পুত্রের মেয়ে (নাতনি)-র ছেলে, পুত্রের মেয়ে (নাতনি)-র মেয়ে, ভাই, বোন। এছাড়াও ওই তালিকায় রয়েছে কন্যাসন্তানের ছেলের ছেলে (প্রপৌত্র), কন্যাসন্তানের ছেলের মেয়ে (প্রপৌত্রী), কন্যাসন্তানের কন্যার ছেলে (প্রপৌত্র), কন্যাসন্তানের কন্যার মেয়ে (প্রপৌত্রী), ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে। বাবার বাবা (ঠাকুরদা), বাবার মা (ঠাকুমা), বাবার ভাই (কাকা), বাবার বোন (পিসি), মায়ের বাবা (দাদু), মায়ের মা (দিদা), মায়ের ভাই (মামা), মায়ের বোন (মাসি)।
আইনজীবী অরিন্দম দাস জানাচ্ছেন, প্রথম ধাপের উত্তরাধিকারীদের অনুপস্থিতিতেই এই দ্বিতীয় ধাপের উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি পাবেন। অর্থাৎ শুধুমাত্র মেয়েই নয়, নাতনি বা প্রপৌত্রীও পেতে পারেন সম্পত্তির অধিকার। আইনে ‘বিবাহিত’ বা ‘অবিবাহিত’ বলে কোনও উল্লেখ নেই। অধিকার থাকে পুত্রবধূরও।
আইনজীবী উল্লেখ করেছেন, বাঙালি পরিবার ও অবাঙালি পরিবারের মধ্যেও পৃথক ধারণা রয়েছে। অবাঙালি পরিবারে সাধারণত একজন কর্তা (হেড অফ দ্য ফ্যামিলি) থাকেন, তিনিই সম্পত্তির মালিক হন। তাঁর থেকে বাকিরা উত্তরাধিকার পায়। আর বাঙালি পরিবারে সেই কর্তা বলে কোনও পৃথক ধারণা নেই।
উত্তরাধিকার নিয়ে কী বলছে আদালত?
২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দেয়, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘কোনও ব্যক্তি যদি চান, তাহলে তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে বঞ্চিত করে সম্পত্তির সব অধিকার দিয়ে দিতে পারেন বিবাহিত কন্যাকে।‘
কর্নাটক হাইকোর্ট ২০২৪ সালে একটি রায়ে উল্লেখ করে, কন্যার যদি মৃত্যুও হয়ে থাকে, তাহলেও তাঁর সম্পত্তির ভাগ তাঁর হাতেই থাকা উচিত। এমনটা না হলে বিষয়টা সংবিধান-বিরোধী হয়।
২০২৪-এ তেলঙ্গানা হাইকোর্টের বিচারপতি এমজি প্রিয়দর্শিনী একটি রায় দেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়, কন্যাসন্তান যদি আর্থিকভাবে সচ্ছলও হয়, সেই যুক্তিতে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
তবে উইল করা থাকলে, সেই অনুযায়ী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টন হবে। সে ক্ষেত্রে না চাইলে, কন্যাসন্তানকে সম্পত্তি না দেওয়া যেতে পারে। সবে আইনজীবী অরিন্দম দাস জানিয়েছেন, সেই ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ করার রাস্তা সবসময় খোলা থাকে। কোন পরিস্থিতিতে উইল লেখা হয়েছে, জোর করে লেখানো হয়েছে কি না, সেই বিষয়গুলিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
মুসলিম আইনে মেয়েরা কি পায় সমান সম্পত্তি?
আইনজীবী অরিন্দম দাস জানিয়েছেন, মুসলিমদের ক্ষেত্রে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নেই। সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু রক্ষণশীলতা আছে, পৃথক বিশ্বাস আছে। সেই অনুযায়ী, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টিও আলাদা। অর্থাৎ মুসলিম পার্সোনাল ল অনুযায়ী, কন্যা (অবিবাহিত) ও পুত্রবধূর পরিবারের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নেই। তবে সম্প্রতি অনেক মুসলিম মহিলা এই ইস্যুতে আদালতে দ্বারস্থ হয়েছেন।