
কলকাতা: ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীরকে সাসপেন্ড করার বিষয়টা খুব একটা আকস্মিক নয়। গত কয়েকমাস ধরেই আবহ তৈরি হচ্ছিল। যেদিন হুমায়ুন বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদ জেলায় দলকে ২০ থেকে ১০-এ নামাব, যেদিন ঘোষণা করেছিলেন নিজের দল গড়তে চান, সেদিনই কেন তৃণমূল কোনও কড়া সিদ্ধান্ত নিল না, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। তবে হুমায়ুন যেন এমন একটা সিদ্ধান্তের জন্য তৈরিই ছিলেন। বাবরি মসজিদ থেকে নিজের দল, ছক একেবারে সাজানো। হুমায়ুনকে সরানোর এই সিদ্ধান্তে আখেরে কি লাভ হল শাসক দলের নাকি আদতে ‘জিতে’ গেলেন হুমায়ুন?
২৬-এ ঘুরবে খেলা!
লাভ-ক্ষতি বুঝতে গেলে জেলার রাজনৈতিক চিত্রটা একটু জানতে হবে। দক্ষিণবঙ্গে উত্তর-ঘেঁষা জেলা মুর্শিদাবাদ। নবাবের জেলা। মুঘল আমলে বঙ্গের রাজধানী মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম অধ্যুষিত। আর পাঁচটা জেলার থেকে সেখানকার সমীকরণ বরাবরই আলাদা। ২০১৬ অর্থাৎ ভরা তৃণমূল জমানাতেও এই জেলায় মূল লড়াই ছিল বাম-কংগ্রেসের। কংগ্রেসের দখলে ছিল ১৪টি আসন, ৪টি আসন ছিল বামেদের বাকি চারটি তৃণমূলের।
পরে খেলা ঘুরতে শুরু করে। বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একসময় এই মুর্শিদাবাদেই তৃণমূলের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন। ২০২১-এ অর্থাৎ যে ভোটের আগে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দিলেন, সেই ভোটেই খেলা ঘুরে গেল। জেলার ২২টি আসনের ২০টিতে জয়ী হল তৃণমূল।
সংখ্যালঘু ভোট থাকবে তো?
২০১১-র সেন্সাস বলছে মুর্শিদাবাদ জেলায় ৬৭ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা। ২২টি আসনের মধ্যে ১৬টিই মুসলিম অধ্যুষিত আসন। তিনটিতে হিন্দু-মুসলিম মোটামুটি সমান আর বাকি তিনটি হিন্দু অধ্যুষিত। অর্থাৎ সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্যই হল মুসলিম ভোট একত্রিত করা। সেখানে হুমায়ুনকে ছেঁটে ফেললে শাসক দল হালে পানি পাবে তো? প্রশ্ন উঠছে জেলার রাজনৈতিক মহলে। যে দল ২০টি আসন জিতেছিল, সেই দল যে সংখ্যালঘু ভোট একত্রিত করতে পেরেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এবার?
ফ্যাক্টর আইএসএফ
শুধুই কি হুমায়ুন? আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আরও অনেকগুলো বিষয় কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে। গত অক্টোবরে মুর্শিদাবাদের লালগোলার তারানগরে পদ্মার ভাঙন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী। দেখে এসেছেন, কীভাবে মানুষ খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছে। মানুষকে বুঝিয়ে এসেছেন সরকার তাঁদের দেখছে না। অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের ভাল-মন্দের খোঁজ নিতে শুরু করেছে আইএসএফ।
ওয়েইসির এন্ট্রি!
নওশাদের দোসর আসাদউদ্দিন! ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের মুখে যেভাবে হঠাৎ মিম সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছিল, এবারও সেই ছবি। গত নভেম্বরে ধুলিয়ানে তৃণমূল ছেড়ে মিমে যোগদান করতে দেখা গেল বহু কর্মীকে। খোরবোনা এলাকায় মিম পার্টির ওই যোগদান ঘিরে উচ্ছ্বাসের ছবি চোখে পড়েছিল। যে দলের একজন মাত্র সাংসদ আছে (আসাদউদ্দিন ওয়েইসি), যে দলের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ তাদের সবার লক্ষ্য মুর্শিদাবাদ?
এই জেলায় বেশিরভাগ মানুষই পরিযায়ী শ্রমিক অথবা বিড়ি শ্রমিক, যাদের অনেক অভাব-অভিযোগ রয়েছে। সেই জেলায় একটু অভাবের খোঁজ নিলেই খেলা ঘুরে যাবে নাতো? প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে। জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর দাবি, মুর্শিদাবাদে লড়াইয়ে দেখা যাবে না তৃণমূলকে। সেখানে বিজেপির সঙ্গে লড়াই হবে কংগ্রেস, বাম ও আইএসএফের।
বাম-কংগ্রেসও ছেড়ে কথা বলবে না
গত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট নজর কেড়েছিল। লোকসভা ভোটে ইউসুফ পাঠান জিতে গেলেও অধীর চৌধুরী প্রভাব খর্ব হতে দিচ্ছেন না। মুর্শিদাবাদে তিনি যথেষ্ট সক্রিয়। আবার নতুন করে এই জেলায় বাম ও কংগ্রেস খাতা খুলতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হল, এই জায়গাগুলোই ধরার চেষ্টা করছেন হুমায়ুন কবীর? বাবরি মসজিদ দিয়ে একত্রিত করতে চাইছেন সংখ্যালঘু ভোট? মনে রাখা দরকার, হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে বাবরি মসজিদ তৈরির কথা বলেননি হুমায়ুন। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে সেই কথা বলে চলেছেন তিনি।
বিজেপির অভিসন্ধি দেখছে তৃণমূল
বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও হুমায়ুন যেভাবে গলা তুলছিলেন, তাতে বিজেপির হাত থাকতে পারে বলে মনে করছে শাসক দল। সরাসরি সে কথা বলেছেন মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিম। তবে বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদার পাল্টা তৃণমূলকেই বলছেন, “হুমায়ুন বহুদিনের কর্মী। প্রথম দিন থেকে নাকি দলে আছেন। তারপরও নিয়ন্ত্রণ নেই? দলের গঠনতন্ত্রের প্রতিই প্রশ্ন উঠছে।” বিজেপি রাজ্য সভাপতি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই হুমায়ুন যখন হিন্দুদের ভাগীরথীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন তো তৃণমূল কোনও ব্যবস্থা নেয়নি! অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলছেন, “হুমায়ুকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিল তৃণমূল।”