সকাল থেকে খিটখিট করছে পূরবী। তার মেজাজটা আজ ভাল নয়। কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে। নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, তোমার কিছু হয়েছে? স্বামীর দিকে ফিরে তাকাল পূরবী। কিছু একটা বলতে চাইল। তারপর কী ভেবে বলল, ও কিছু না। তুমি অফিস যাও। কথা বাড়াল না নিখিলেশ। শুধু দেখল, মায়ের মতো তার নয় বছরের কন্যাও আজ কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে। তার চোখেমুখে কেমন যেন আতঙ্ক। একটা ভয়। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, কী রে তুলি, তোর কী হল? মেয়ে কিছু বলল না। শুধু মায়ের কোলে ঘেঁষে মাকে জড়িয়ে ধরল। মা-মেয়েকে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল নিখিলেশ। সাবধানে থেকো বলে অফিস চলে গেল।
নিখিলেশ অফিস চলে যাওয়ার পর মা-মেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মেয়েকে বুকের কাছে টেনে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পূরবী। তারপর কী ভেবে বলল, তুই ওই রুমে গিয়ে একটু খেল। তুলি পাশের রুমে চলে গেলে ফোনটা হতে নিয়ে কী একটা ভাবল পূরবী। ফোন করল তার বান্ধবী পায়েলকে। পুরো রিং হয়ে গেল। পায়েল কেন ফোনটা তুলল না? ব্যস্ত আছে? আরেকবার করবে কি না ভাবতে ভাবতে পায়েলের ফোন এল। ফোনটা তুলে পূরবী বলল, তুই কি ব্যস্ত আছিস? পায়েল বলল, আরে না, না। পূরবী বলল, তোর সঙ্গে একটা কথা আলোচনা করার আছে। পূরবীর গলাটা একটু কাঁপছে মনে হল পায়েলের। বলল, আরে কী হয়েছে। বল আমায়।
পায়েল বলল, “তুলির গতকাল প্রথম পিরিয়ড হয়েছে। রক্ত দেখে ও ভয় পেয়েছে। কান্নাকাটি করছিল। আমিও একটু চিন্তায় রয়েছি। এই তো সবে ন’বছর বয়স। এই বয়সে পিরিয়ড। আমাদের তো বারো-তেরো বছর বয়সে হয়েছিল। খারাপ কিছু হয়নি তো? কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। ওর বাবাকে এখনও কিছু বলিনি।” পায়েলেরও মেয়ে রয়েছে। বছর আটেক বয়স। সে বলল, বেশি চিন্তা করিস না। একবার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বল।
উপরের লেখাটা কোনও গল্পের প্লট নয়। আমাদের দেশে লক্ষ-লক্ষ মা-মেয়ের কাহিনি। যেখানে মেয়ের কম বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েন মায়েরা। নানা প্রশ্ন জাগে তাঁদের মনে। নয় বছর বয়সে ঋতুস্রাব নিয়ে কি সত্যিই ভয়ের কোনও কারণ আছে? মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর বয়স সাধারণত কত? আগের তুলনায় ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কি কমেছে? প্রথম ঋতুস্রাবের আগে মেয়েদের শরীরে কী কী লক্ষণ দেখা যেতে পারে? কী বলছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা?
ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কি কমেছে?
আগের তুলনায় মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমেছে। বললেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, আগে সাধারণত ১৩-১৪ বছর বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হত। এখন ৯-১০ বছর বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হয়। এমনকি, আট বছরে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে। ৯-১০ বছর কিংবা ৮ থেকে ১৩-র মধ্যে হলে ভয়ের কিছু নেই।
তবে, আট বছরের আগে ঋতুস্রাব শুরু হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। আট বছরের আগে ঋতুস্রাব শুরুর নানা কারণ থাকতে পারে। ওভারি টিউমার। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কোনও অসুখ। এসব রেয়ার কিছু কারণে আট বছরের আগে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে। তাই, আপনার কন্যার যদি আট বছরের আগে ঋতুস্রাব শুরু হয়, অবশ্যই চিকিৎসক দেখাবেন।
ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমার কারণ কী?
চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলেন, এটা বলা মুশকিল। দেখা গিয়েছে, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়ার প্রভাব পড়ছে শরীরে। আবার কিছু কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো খেলে হরমোনের উপর প্রভাব পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি বোধহয় প্রভাব পড়েছে সেডেনটারি লাইফস্টাইলের জন্য। বর্তমান সময়ে শিশুরা খেলাধূলা করছে কম। হয় তারা বসে টিভি দেখছে, নয় চেয়ার-টেবিলে বসে পড়াশোনা করছে। নয়তো বসে বসে ফোন দেখছে। শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ।
চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলেন, শুধু ভারত নয়। বিশ্বব্যাপীই মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমেছে। আমরা এখন কার্যত গ্লোবাল ভিলেজে বাস করছি। ফলে বিশ্বজুড়েই মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর বয়স এগিয়ে এসেছে।
কী বলছে পরিসংখ্যান?
পরিসংখ্যান বলছে, মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর গড় বয়স ১২.৪ বছর। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সময়ের সঙ্গে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমেছে। হার্ভাডের একটি গবেষণায় অংশ নেওয়া মহিলাদের মধ্যে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের ঋতুস্রাব শুরুর গড় বয়স ১২.৫ বছর। অন্যদিকে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের ঋতুস্রাব শুরুর গড় বয়স ১১.৯ বছর। ওই গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, গবেষণায় অংশ নেওয়া সেইসব মহিলাদের ৮.৬ শতাংশের প্রথম ঋতুস্রাব হয়েছে ১১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। অন্যদিকে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, গবেষণায় অংশ নেওয়া সেইসব মহিলাদের ১৫.৫ শতাংশের প্রথম ঋতুস্রাব হয়েছে ১১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। ১১ বছর বয়স হওয়ার আগে ঋতুস্রাব শুরুর সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে।
ঋতুস্রাব শুরুর আগের লক্ষণগুলি কী কী-
চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলেন, কোনও মেয়ের ঋতুস্রাব শুরুর আগে বেশ কিছু লক্ষণ ফুটে উঠে। মায়েরা একটু নজর দিলেই বুঝতে পারবেন। পিরিয়ড শুরুর বছর দুয়েক আগে থেকে ব্রেস্ট ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়। এমনকি, পিরিয়ড শুরুর বছর খানেক আগে থেকে পিউবিক হেয়ারের বৃদ্ধি ঘটে। ফলে সন্তানের পিরিয়ড শুরুর আগে এইসব বিষয়গুলি নজরে রাখলে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার সন্তানের পিরিয়ড কখন শুরু হতে পারে। চিকিৎসক বলেন, “আমি আবার বলছি, ৮-৯ বছরে পিরিয়ড শুরু হলে চিন্তার কিছু নেই। কারও পিরিয়ড ১৩ বছরে শুরু হতে পারে। কারও আরও কম বয়সে। আপনার সন্তান কখন বয়ঃসন্ধিতে পা দিচ্ছে, সেই লক্ষণগুলির দিকে নজর রাখলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
ঋতুস্রাব নিয়ে আপনার কন্যাকে বোঝান-
ঋতুস্রাব সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়া। আপনার সন্তানের মধ্যে বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলো ফুটে উঠলে তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে সহজ কথায় বোঝান। এতে ভয়ের কিছু নেই, সেই বিশ্বাস তার মনে ঢুকিয়ে দিন। চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলেন, প্রথম ঋতুস্রাবের সময় অনেক বাচ্চা মেয়েই কুঁকড়ে থাকে। সহজে স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গেও মিশতে পারে না। সেইসময় তার পাশে থাকুন। একইসঙ্গে ঋতুস্রাবের সময় কন্যার যত্ন নিন। তার বয়স একদম কম। এই বয়সে হয়তো সে নিজের খেয়াল রাখতে পারবে না। ফলে সময়ে স্যানিটারি প্যাড বদলানোর দিকে নজর রাখতে হবে অভিভাবককে।
কারও কারও ক্ষেত্রে দেরিতে শুরু হয় ঋতুস্রাব। এর কারণ কী?
চিকিৎসকরা বলছেন, ৮ বছর বয়সে যেমন ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে, তেমনই ১৭ বছর বয়সেও হতে পারে। বয়ঃসন্ধির লক্ষণ ফুটে ওঠার ২ বছর পর সাধারণত ঋতুস্রাব হয়। কম ওজন, অতিরিক্ত শারীরিক কসরত, কিংবা হরমোনের অসামঞ্জস্যের ফলে দেরিতে শুরু হতে পারে ঋতুস্রাব। তবে ১৫ বছরের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু না হলে চিকিৎসককে দেখানো দরকার। তিনি হয়তো রক্ত পরীক্ষা করতে দিতে পারেন। ১৩ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধির লক্ষণ দেখা না গেলেও চিকিৎসককে দেখানো দরকার।
ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমে আসায় কি মেনোপজের বয়সও কমে আসছে?
একদমই না। স্পষ্ট করলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, মেনোপজের বয়স কমে আসেনি। মেনোপজের বয়স সাধারণ ৪৮ থেকে ৫২ বছর। ঋতুস্রাব শুরুর বয়স কমে এলেও মেয়েদের ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার বয়স একই রয়েছে। ফলে এই নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাড়ির দরজায় নক করার আগে থমকে দাঁড়াল নিখিলেশ। সকালে মা-মেয়েকে থমথমে মুখে দেখে গিয়েছে। এখন বাড়ির পরিবেশ কেমন রয়েছে? কী হয়েছে কে জানে। ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বাজাল সে। দরজা খুলল তুলি। মুখে হাসি। পাশে দাঁড়িয়ে পূরবী। তারও মুখ উজ্জ্বল। স্বস্তি পেল নিখিলেশ। মনে মনে বলল, ঋতুর পরিবর্তন হোক। মেয়ের মুখের অম্লান হাসি যেন না যায়।
সমাজের সব বাবা-মায়েরই তো একটাই চাওয়া, তুলিদের মুখে হাসি যেন লেগে থাকে।