সিজার মণ্ডলের রিপোর্ট
খুব বিপদে পড়েছেন, টাকা না পেলে কোনও উপায় নেই, এমন পরিস্থিতিতে যদি হঠাৎ আপনার মোবাইলে লোনের অফার আসে। কম সুদে বেশি টাকা ঋণ নেওয়ার লোভ এড়াতে পারেন না অনেকেই। আর সেই ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ! এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা গায়েব হয়ে যায় অ্যাকাউন্ট থেকে। ভুয়ো ফোন, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপে প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়। তবে সেই টাকাগুলো যায় কোথায়? ‘নাইজেরিয়ান ফ্রড’ বা ‘জামতারা গ্যাং’-এর কথা অনেকেই শুনেছেন। এবার গোয়েন্দাদের হাতে আসছে নতুন তথ্য। প্রতারণার চক্রের শিকড় আসলে চিনে?
নাইজেরিয়ান ফ্রড
ভারতে বিভিন্ন প্রতারণার মামলায় নাইজেরিয়ার অনেক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। চলতি বছরেই দিল্লি থেকে তিনজন নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে নাগপুরের আরও একটি অনলাইন প্রতারণার ঘটনায় গ্রেফতার হন নাইজেরিয়ার নাগরিক। এমন উদাহরণ আছে অনেক। তাই সাইবার প্রতারণার চক্র ‘নাইজেরিয়ান ফ্রড’ বলে পরিচিত ছিল।
জামতারা-ভরতপুর এখন অতীত
সাম্প্রতিককালে সাইবার প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে জামতারার নাম। গোটা দেশ জুড়ে মাকড়সার জালের মতো প্রতারণার ফাঁদ পাতা ওই ঝাড়খণ্ডের জামতারা থেকে। একেক জন গ্যাং মেম্বার এই প্রতারণা থেকে দিনে এক-দেড় লক্ষ টাকা রোজগার করেন, এমন তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সব সময় যে তারা ধরা পড়ে, এমনটাও নয়। অ্যাকাউন্টের পর অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দিতে জামতারা গ্যাং-এর জুড়ি নেই, এমনটাই মনে করা হয়। জামতারার পর ভরতপুরের গ্যাং-এর নামও শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। তবে এই সব গ্যাং এখন অতীত। গোয়েন্দারা বলছেন, বর্তমানে ভারতে হওয়া সাইবার অপরাধের ‘কন্ট্রোল’ রয়েছে চিনের হাতে।
গেমের ‘খেল’! টাকা চলে যায় যাচ্ছে চিনে
২০২৩ সালের মে মাসের ঘটনা। কলকাতার কাশীপুর থানায় প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন শেখর পাল নামে এক ব্যক্তি। বছর ৩৭-এর ওই ব্যক্তি গোপাল লাল চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা। তাঁর অভিযোগ ছিল, করোনাকালে FIEWIN নামে একটি গেমিং অ্যাপ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ইন্টারনেটে। ওই গেমিং অ্যাপে বিভিন্ন ধরনের গেম খেলতেও শুরু করেন তিনি। ক্রমশ নেশা বাড়তে থাকে তাঁর। এরপর শুরু হয় টাকার খেলা।
কিছু টাকা লগ্নি করে খেললে গেম জিতে গেলে ফেরত পাওয়া যেত অধিকতর টাকা। লিখিত অভিযোগে ওই ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, প্রথম দিকে অল্প অল্প করে টাকা দিয়ে, বেশ কিছু টাকা তিনি গেম থেকে জিতে যান। এরপর লাভের আশা বাড়তে থাকে। বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে শুরু করেন তিনি। গেমের নেশায় ঋণ নিয়ে লগ্নি করা শুরু করেন। এইভাবে ধার করে তিনি প্রায় ২১ লক্ষ টাকা লগ্নি করে ফেলেন। জেতার ফলে গেমিং অ্যাপের অ্যাকাউন্টেও টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে, জমা হয় প্রায় ১৩ লক্ষ টাকার বেশি।
কিন্তু মুস্কিলটা হল এরপরই। সেই টাকা কোনওভাবেই অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে ওই ব্যক্তি যখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন, তখন হঠাৎ তিনি দেখেন অ্যাপটি অফলাইন হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ আর অনলাইনে খেলাই যাচ্ছে না ওই গেম। মাথায় হাত পড়ে যায়। ততক্ষণে ২১ লক্ষ টাকা চলে গিয়েছে। সেই টাকা ফেরাবেন কী করে, বুঝতে না পেরে কাশিপুর থানায় অভিযোগ ২০২৩-এর ১৬ মে।
মানি ট্রেল খুঁজতে গিয়ে তদন্তকারীদের চোখ কপালে
এই অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতারণার মামলা শুরু করে কলকাতা পুলিশ। ২০২৪-এ সেই মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট একটি এফআইআর দায়ের করে। ওই এফআইআর-এর ভিত্তিতে একটি মামলা হয়। তদন্তে দেখা যায়, শেখর পাল যে টাকা ইউপিআই (UPI)-এর মাধ্যমে দিয়েছিলেন, সেই টাকা মূলত নয়ডা, সিঁথি এবং নিউটাউনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছিল।
সেই তদন্তের সূত্র ধরে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট চারজনকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেফতার করে। ধৃতদের মধ্যে একজন চেন্নাইয়ের বাসিন্দা। তাঁর নাম জোসেফ স্টালিন। ধৃতদের মধ্যে ছিলেন বিহারের শরিফের বাসিন্দা চেতন প্রকাশ। ওড়িশার সুন্দরগড়ের বাসিন্দা আলোক কুমার সাহু এবং অরুণ কুমার সাহুকেও গ্রেফতার করা হয়।
কোথায় যাচ্ছে টাকাগুলো? সেটা বুঝতে ধৃতদের জেরা করে কেন্দ্রীয় সংস্থা। প্রতারণার
টাকার মানি ট্রেল (money trail) খুঁজে বের করা হয়। অর্থাৎ ওই টাকা কোথায়, কীভাবে লেনদেন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হয়। সেখান থেকে তিনটি সংস্থার নাম পাওয়া যায়। সংস্থাগুলি হল চেন্নাইয়ের ‘স্টুডিও ২১ টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড’, তামিলনাড়ুর ‘ইশাপস টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘নারাচি ইন্টারনেট প্রাইভেট লিমিটেড’। তদন্তে দেখা যায়, এই তিনটি সংস্থার মাধ্যমেই প্রতারণার টাকা বিদেশে পাচার হত।
কাশীপুরের শেখর পালের টাকা চলে গেল চিনে!
এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, চেন্নাইয়ের স্টুডিও ২১ নামে ওই সংস্থার এক ডিরেক্টরের নাম জোসেফ স্টালিন এবং অন্য ডিরেক্টর হলেন চিনা নাগরিক পেই পেঞ্জুইন (PEI PENGYUN)। বিহারের সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর চেতন প্রকাশ। মানি ট্রেলের সূত্র ধরে আরও তিন চিনা নাগরিকের হদিশ মেলে। তাঁদের নাম জং লংলং, জাং ওয়েঞ্জিন, হুয়াং লিয়াংলিয়াং।
এই তিনজনের ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টে ২৪ কোটি টাকার হদিশ পাওয়া যায়, যা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে কনভার্ট করা হয়ে গিয়েছিল। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, এই তিন চিনা নাগরিক কখনই ভারতে আসেননি। ভারতের সঙ্গে সরাসরি কোনও যোগও নেই।
তদন্তকারীদের দাবি, স্টালিনের মতো লোকেরা আসলে ভারতে এজেন্টের কাজ করে। তাদের হাত দিয়েই চিনের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে বিপুল টাকা। চলে যায় ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টে।
এটা তো গেল একটা উদাহরণ। বাংলা, ওড়িশা সহ একাধিক জায়গায় এমন সব প্রতারণার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। চিনা নাগরিকদের নাম পর্যন্ত হাতে এসে গেলেও, তাদের নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়নি।
কীভাবে জালিয়াতি করে চিন?
‘লোন অ্যাপ’ দিয়ে প্রতারণার দুনিয়ায় পা রাখে চিন। এরপর একে একে গেমিং অ্যাপে প্রতারণা। আর এখন ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ নামে নয়া প্রতারণা। সেখানেই শেষ নয়, স্টক মার্কেটে জাল বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছে অনেকেই। পিছনে সেই চিন। তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ প্রতারণার মাধ্যমে ১২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। গত এক বছরে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে।
সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিৎ মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রতিদিন আমরা যে ফোন ব্যবহার করি বা ফোনে অ্যাপ ব্যবহার করি, সেই সব প্রোডাক্টের মধ্যে বেশিরভাগই চিনের। ফলে সহজেই চিনের সার্ভারে জমা হচ্ছে ভারতীয়দের তথ্য। অর্থাৎ নিজের অজান্তেই অনেকে চিনের হাতে তুলে দিচ্ছেন ব্যক্তিগত তথ্য।
মেকং নদীর পাড় থেকেই চলছে প্রতারণা চক্র?
চিনের মেকং নদীর ধারে রয়েছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল স্পেশাল ইকনমিক জোন বা GTSEZ।
আর্থিক উন্নয়নের জন্য ২০০৭ সালে ৩০০০ হেক্টর জমি জুড়ে এই জোন তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে রয়েছে অনেক ক্যাসিনো, রয়েছে রিসর্ট। কিছুদিনের মধ্যেই ড্রাগ, মানব পাচার সহ নানা অবৈধ কারবারের ডেরা হিসেবে পরিচিত হয় ওই GTSEZ। ভারতীয় গোয়েন্দাদের অনুমান সেই জোন থেকেই ভারতে সাইবার ফ্রড চালানো হচ্ছে।
অভিযোগ, চিনের এই চক্র আসলে ঘুরপথে সাহায্য পায় চিনের সরকারের তরফ থেকেও। সম্প্রতি ডিজিটাল অ্যারেস্ট নিয়ে করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ডিজিটাল অ্যারেস্ট নামে কোনও ব্যবস্থা আইনে নেই। এটা পুরোটাই প্রতারণা। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে না হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগ করার কথা বলেন তিনি।