কলকাতা: প্রায় দু’ মাসের ভোটপর্ব (Assembly Election Result 2021)। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন বাংলা-সহ চার রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিধানসভা ভোটের দিন ঘোষণা করে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই রাজ্যজুড়ে ভোটপ্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। নজর কেড়েছে বিজেপির প্রচার কৌশল। কেন্দ্রীয় নেতাদের পর্যবেক্ষক করে আনা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় রোজই কেউ না কেউ বাংলায় এসেছেন। নির্বাচনী প্রতিটা বিষয় নজরে রেখেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তাঁরা আশাবাদী ছিলেন এবার ২০০ পার হচ্ছেই। কিন্তু রবিবার ফলাফলের ট্রেন্ড প্রথম থেকেই তৃণমূল ঘেঁষা। বেলা যত এগিয়েছে কমতে কমতে একটা সময় বিজেপি ৭০-এর নিচে নেমে গিয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখা অবধি ভোটের সম্পূর্ণ গণনা সমাপ্ত হয়নি। তবে হার মেনে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছেন, “তৃণমূলের জয়কে আমরা ছোট করে দেখছি না। যদি কোনও ত্রুটি থাকে সেটা আমাদের।” রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও আত্ম সমালোচনার কথা বলেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যেই ভরা বাজারে বিজেপির এই ফলাফল কারণ হিসাবে বেশ কয়েকটি বিষয়কে তুলে ধরেছেন-
* এর মধ্যে প্রথমেই উঠে এসেছে মেরুকরণ প্রসঙ্গ। হিন্দুত্ব, মতুয়া ভোট কিংবা তফশিলি, অবাঙালি ভোটকে এবার বিজেপি তাদের একটা বড় শক্তি হিসাবে ধরে নিয়েছিল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে ভোটবাক্স খুলতেই দেখা গেল, আদতে তা বিশেষ কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
* মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতার বিরুদ্ধে সমান জনপ্রিয় মুখের অভাবকেও কেউ কেউ বিজেপির এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে দেখছেন। তাঁদের কথায়, পোক্ত সংগঠনের দৌড়ে তৃণমূলের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে বিজেপি। মেরুকরণের আবহ তৈরি হলেও ভোটারদের বড় অংশ সাড়া দেননি।
আরও পড়ুন: ‘আমাদের ত্রুটি ছিল’, মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আত্মসমালোচনা বিজেপির
* বারবার ভোট প্রচারে তৃণমূলকে ‘তোলাবাজ’, ‘কয়লা চোর’, ‘ত্রিপল চোর’ বলে দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে প্রচার করেছে বিজেপি। তৃণমূলের বহিরাগত তত্ত্বের সামনে বিজেপির তোলা গরু-কয়লা পাচারের অভিযোগ সমান জায়গা করে নিতে পারেনি।
* বিজেপি প্রার্থী ঘোষণা করতেই জায়গায় জায়গায় শুরু হয়েছিল ‘বিদ্রোহ’। কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে পর্যন্ত সে আঁচ এসে পৌঁছয়। দল অবশ্য বলেছিল, কয়েকদিন এসব চলবে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সিঙ্গুর, উত্তরপাড়া, বালি সর্বত্র সে ছবি মানুষ দেখেছে। ভোটের ফলাফলে দিন দেখা গেল সেসব ‘ঠিক’ হয়নি। প্রতিটিতেই হার হয়েছে তৃণমূল থেকে যাওয়া বিজেপি প্রার্থীদের। অর্থাৎ আদি বনাম নব্যের কাঁটা গলায় বিঁধেছে বারবার।
* শুধু ভোটের মুখে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি যাওয়া ‘দলবদলু’রাই নন, একাধিক টলিপাড়ার তারকাকেও টিকিট দেওয়া হয়েছে। তাতেই ক্ষোভ বেড়েছে দলের অন্দরে। যারা প্রথম থেকে দলের ঝান্ডাধারী তাঁদের ছেড়ে কেন হঠাৎই এই টেলিভিশনের পর্দার ভিতরে থাকা মানুষগুলো টিকিট পেলেন তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই বিষয়টি ভালভাবে নেননি অনেকেই। মুখে কিছু না বললেও তার প্রতিফলন পড়েছে ভোটে। অন্য দল থেকে এসেই বিজেপির টিকিট, ভোটারদের একটা বড় অংশও ভালভাবে নেননি।
* পাশাপাশি আরও একটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বিজেপির এই ফলাফলের পিছনে প্রভাব থাকতে পারে অত্যাধিক পরিমাণে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ। লোকসভা ভোটেও নির্বাচনী কমিটি ছিল রাজ্যের জন্য। কিন্তু এবার তা দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গোটা বিষয়টি হাতের তালুতে রেখেছে। প্রার্থী বাছাই পর্যন্ত হয়েছে দিল্লি থেকে। বাংলা থেকে নেতারা নাম পাঠিয়েছেন, সিলমোহর দিয়েছেন দিল্লির নেতারা। প্রচারেও কেন্দ্রীয় নেতারাই মূলত গুরুত্ব পেয়েছেন। যাঁরা বাংলায় থাকেন, যাঁদের দায়িত্ব বাংলাকে সামলানো তাঁদের সে ভাবে প্রচারে দেখা যায়নি। ফলে সেটাও একটা প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও এগুলি সবই আলোচনা সাপেক্ষ। বিজেপি তাদের মত করে এই অপ্রত্যাশিত ফলের কারণ বিশ্লেষণ করবে। তবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য এ রাজ্যে যে ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই থাকছে তা বলাই বাহুল্য।