
কলকাতা: বাংলায় ওয়াকফ হবে না। কয়েক মাস আগে পর্যন্ত এটাই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা। কিন্তু সেই সব বার্তা, প্রত্যাশাকে ঘুরিয়ে দিল একটা সরকারি নির্দেশিকা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলাশাসকদের পৌঁছে গিয়েছে সেই চিঠি। যার মাথায় লেখা উমিদ পোর্টালে তুলতে হবে ওয়াকফ তথ্য। কিন্তু যে ওয়াকফ নিয়ে এত আপত্তি রাজ্যের। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলায় ওয়াকফ হবে না। তারপরেও কীভাবে জারি হল এই নির্দেশিকা? ভোটমুখী বাংলায় এর প্রভাব পড়বে না তো?
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্যের সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর। নির্দেশিকায় স্বাক্ষর করেছেন দফতরের সচিব পিবি সালিম। কিন্তু কী রয়েছে সেই নির্দেশিকায়? সরকারি ওই নির্দেশিকায় স্পষ্ট হরফে লেখা রয়েছে, রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত সব তথ্য আপলোড করতে হবে উমিদ নামে কেন্দ্রীয় পোর্টালে।
কেন্দ্র প্রতিটি রাজ্য়কে তথ্য আপলোড করার জন্য় যে ছয় মাসের সময়সীমা দিয়েছিল, তা এই নির্দেশিকায় স্পষ্ট। কিন্তু ওয়াকফ প্রসঙ্গে বাংলা প্রথম থেকেই থেকেছে গররাজি। কিন্তু ওই ওয়াকফ-বরফ এখন যেন গলে জল। মন্ত্রকের নির্দেশিকায় লেখা, ‘উমিদ পোর্টাল তৈরির ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির তথ্য সেই পোর্টালে আপলোড করতে হত। আপাতত এই ছয় মাসের সময়সীমা ৫ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে। তাই এই সময়ের মধ্যে রাজ্য়ের ৮২ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তির তথ্য আপলোড করতে হবে কেন্দ্রীয় পোর্টালে।’ অর্থাৎ ওয়াকফ সংশোধনী আইনে ঢোকটা শেষমেশ গিলল রাজ্য। অবশেষে এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘সুবিধা হবে’ বলে দাবি শাসকপক্ষের। দলের মুখপাত্র তথা কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘মোদী সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বিক্রি করা হয়ে গিয়েছে। এবার নজর পড়েছে ওয়াকফ এস্টেটগুলিতে। রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি যাতে ওয়াকফ বোর্ডের আওতায় থাকে, সেটাকে সুনিশ্চিত করতেই আমরা নতুন নির্দেশিকা জারি করেছি।’
বলে রাখা প্রয়োজন, এই ওয়াকফ সম্পত্তির নিরিখে এগিয়ে বাংলা। বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে উত্তর প্রদেশে। সেখানে মোট ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ২ লক্ষ ১৭ হাজার ১৬১টি। এরপরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলা। রাজ্য়ের ওয়াকফ বোর্ডের ওয়েবসাইট বর্তমানে বাংলায় মোট ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ৮২ হাজার ৬১৬টি। আর এই কথা বলেছেন প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীও। প্রাক্তন সাংসদের কথায়, ‘বাংলায় প্রচুর ওয়াকফ সম্পত্তি। এই সুবাদে রেজিস্ট্রেশন না হওয়া জমিগুলি মাফিয়ারা দখল করে নিতে পারে বলেই আশঙ্কা।’
এক কথায় বলতে গেলে, বাংলার ভোটের বাজারে ওয়াকফের যে একটা ভাল পরিমাণ অংশীদারিত্ব থাকবে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু এই নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে কেন আপত্তি ছিল রাজ্য়ের শাসকশিবিরের? এই প্রসঙ্গে একাধিক যুক্তি রয়েছে। তৃণমূল সাংসদ কল্য়াণ বন্দ্য়োপাধ্য়ায় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ওয়াকফ সংশোধনী আইন মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলের প্রতি স্তরের নেতার মুখে ওয়াকফ নিয়ে শোনা গিয়েছে বিরূপ মন্তব্য। ওয়াকফ সংশোধনী আইন দিনশেষে মূল আইনের কাঠামোকে সম্পূর্ণ ভাবে বদলে দিচ্ছে বলেই অভিযোগ ছিল রাজ্যের শাসকশিবিরের। কিন্তু এই সব অভিযোগ, বিরোধিতার পরে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পরিণত হয়েছে আইনে। তার মাস সাতেক পর সেই আইন মেনে নিয়েছে বাংলা। এই প্রসঙ্গেই বলে রাখা প্রয়োজন, ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেও মামলা উঠেছিল। সমগ্র সংশোধনী নিয়ে আপত্তি জানায়নি শীর্ষ আদালত, বরং কয়েকটি ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল আংশিক স্থগিতাদেশ।
হাজার আপত্তি পেরিয়ে ওয়াকফ স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজ্যের বিরুদ্ধে কটূ কথা উঠবে, এটাই খুব স্বাভাবিক। যেমন, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথায়, ‘ঠেলায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। বাবা সাহেব অম্বেদকরের সংবিধান শেষ কথা বলবে।’ অন্যদিকে, একাংশের সংখ্যালঘুদের মুখ তথা ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বড্ড রুষ্ঠ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে বললেন মানা হবে না, এখন মেনে নিলেন। এসআইআর নিয়েও বলেছিলেন। কিন্তু রাজ্যে এখন এসআইআর চলছে।’
একই সুর ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর দাবি, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ওয়াকফ লাগু হতে দেবেন না। ওনার আমলেই তো সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি চুরি হয়েছে।’ একযোগে আক্রমণ করেছে ত্বহা সিদ্দিকীও। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্য়ে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয় দেখছেন তিনি। ত্বহার কথায়, ‘যাই করুন না কেন, কেন্দ্র এঁদের নির্দেশ দিচ্ছে। রাজ্য সেটাই করছে।’
বছর ঘুরলেই বাংলায় নির্বাচন। যে ওয়াকফ গোটা বাংলাকে সপ্তাহ কয়েকের জন্য নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই ওয়াকফ কি ভোটের অঙ্কে প্রভাব ফেলবে না? কেন্দ্র যখন ওয়াকফ সংশোধনী বিলকে আইনে পরিণত করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই আবহে ওয়াকফ বিরোধিতায় কেঁপে উঠেছিল বাংলা। শহর কলকাতা হোক বা জেলা, ওয়াকফ সংশোধনীর বিরোধিতায় প্রতিবাদ মিছিল, বচসা, সংঘাত কয়েক দিনের স্তব্ধ করে দিয়েছিল বাংলাকে। বললেও ভুল হবে না এই সংঘাত কোথাও কোথাও রূপ নিয়েছিল হিংসারও। পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামতে হয়েছিল খোদ মমতাকে। একাধিক ইমাম সভায় গিয়েছিলেন তিনি। বাংলার যে কোনও দায় নেই সেটাও স্পষ্ট করেছিলেন।
কিন্তু সেই ওয়াকফকেই হাজার আপত্তি পেরিয়ে মেনে শেষমেশ নিল রাজ্য। তাও আবার নির্বাচন যখন দোরগোড়ায়। রাজ্যের সংখ্যালঘুরা রেগে যাবেন না তো? তৃণমূলের ভোটে প্রভাব পড়বে না তো? অঙ্ক বলছে, বাংলায় ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী মোট ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোট। গত দশ বছরে এই সংখ্যা যে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। বাংলার এই সংখ্য়ালঘু ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ রয়েছে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, হুগলি এবং ভাঙড় সংলগ্ন এলাকায়। শেষ লোকসভা নির্বাচনের হিসাব বলছে, রাজ্যের ৭৮টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্য়ে ৫৪টি বিধানসভায় এগিয়ে তৃণমূল। মোট ভোট পেয়েছে ৪৬ শতাংশ।
সামনেই বিধানসভা নির্বাচন, এই আবহে ওয়াকফকে স্বীকৃতি কোথাও গিয়ে ভোটের ময়দানে তৃণমূলকে ব্যাকফুটে ফেলবে না তো? বলা বাহুল্য রাজ্যের এই মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাবটাই সর্বোচ্চ। যা ফুটে উঠেছে খাতায়-কলমেও। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূলের অভিসন্ধি এই ক্ষেত্রে অনেকটাই অস্ত্র হিসাবে কাজ করতে পারে। ওয়াকফ নিয়ে তৈরি হওয়া ক্ষোভ বিজেপির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে তাঁরা। কিংবা সেই কাজে ব্যর্থ হলে তৃণমূলেরই ভোট কাটতে পারেন হুমায়ুন। যদিও তাঁর দল খোলা এখনও অনেকটাই আধারে।