সলতে পাকানোর কাজটা অনেক আগে থেকেই চলছিল। অগ্নিসংযোগটা হয়ে গিয়েছিল পটনার বৈঠকে। এবার সেই আগুনের তাপেই বিজেপিকে ঝলসাতে চাইছে বিরোধীরা। NDA বনাম INDIA। খাতায় কলমে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের রণডঙ্কা বেজে গিয়েছে বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোটের বৈঠকের পরেই। মমতার ‘ফেভারিট’ রাহুল গান্ধী থেকে লালু ‘মিত্র’ নীতীশ কুমার, সীতারাম ইয়েচুরি থেকে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, অরবিন্দ কেজরীবাল- ‘গাঢ়’ লাল থেকে ‘ফিকে’ গেরুয়া, বেঙ্গালুরুর বৈঠকে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। লক্ষ্য একটাই, আবকি বার INDIA সরকার। কিন্তু, এত ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ, ভিন্ন মত, আঞ্চলিক বিরোধিতা সামলে জোটের ফসল ঘরে তুলতে পারবে তো বিরোধীরা? ভোটের শেষে বাজবে তো বিবিধের মাঝে মিলন মহানের সেই ফিকে হয়ে যাওয়া সুরটা? এ প্রসঙ্গেই TV9 বাংলা ডিজিটালের প্রতিনিধি নির্ণয় ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে কথা বললেন সিপিআইএমএল লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
কেমন হল বেঙ্গালুরুর বৈঠক?
বৈঠক খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। পটনার বৈঠকের থেকে বেঙ্গালুরুর বৈঠকে আরও অনেক বেশি গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। পটনার পরে বেঙ্গালুরুর এই মিটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিছুদিন আগেই কর্নাটকে নির্বাচন হয়েছে। সেখানে সমস্ত সম্প্রদায়িক প্রচারকে উপেক্ষা করে যেভাবে কর্নাটকের মানুষ বিজেপিকে পরাজিত করেছে, সেটা সমগ্র ভারতবর্ষের পরিবেশকে কিছুটা পাল্টে দিয়েছে। ফলে দ্বিতীয় বৈঠক বেঙ্গালুরুতে হল। তৃতীয় বৈঠক রয়েছে মহারাষ্ট্রে। আমি মনে করি এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওখানেও সরকারকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। পার্টিগুলিকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তারপরেও ঝড়-ঝাপটা সামলে বৃদ্ধ বয়সে শরদ পাওয়ার নতুন করে পার্টি দাঁড় করানোর কথা ভাবছেন। উনিও এই জোটের সঙ্গে রয়েছেন। ফলে মহারাষ্ট্র যেটা করছে সেটা আজকের ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর হয়তো দিল্লিতে কোনও বৈঠক হবে।
বৈঠক স্থল হিসাবে কি শুধুই বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিকে বেছে নেওয়া হচ্ছে? কলকাতাতেও কি হবে এই বৈঠক?
আমার মনে হয় বিরোধী শাসিত বলে নয়। এই জায়গাগুলির রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক। সেই জন্য কলকাতা-সহ অনেক জায়গাতেই এই বৈঠক হতে পারে। যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানেই হবে। বৈঠক ছাড়াও আমরা আন্দোলনের কর্মসূচি নেব। সেটা গোটা দেশেই চলবে। আমরা তো আগামী নির্বাচনটাকেই একটা আন্দোলনে পরিণত করার আহ্বন জানিয়েছি।
ভিন্ন ভাবনা এবং মতাদর্শের একগুচ্ছ দল আজ এক ছাতার তলায়! শিবসেনা ও লিবারেশন একসঙ্গে কোনও আন্দোলনে অংশ নিলে কর্মীদের মধ্যে কোনও অস্বস্তি এবং বিভ্রান্তি কাজ করবে না?
আসলে একটা বিরাট মতাদর্শগত বৈচিত্র নিয়েই এই জোটটা গড়ে উঠছে। আমার মনে হয় গণতন্ত্র কথাটার মধ্যেই এর উত্তর রয়েছে। তাতে বিভিন্ন মতাদর্শ থাকবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারা থাকবে। কিন্তু, আজ ভারতে প্রকৃতপক্ষেই গণতন্ত্রের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিজেপি চাইছে একদলীয় শাসন। ৫০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে ওরা। সমস্ত সরকারি ও সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে অকেজো করে দিচ্ছে। এছড়াও বেসরকারি সামাজিক হিংসার চারা গাছ ওরা পুঁতছে। মনিপুরে আজ যা ঘটছে তা বিজেপির রাজনীতির বড় ফল। যখন মনিপুর জ্বলছে, তখন ওরা চুপ। ওরা আসলে গোটা দেশকে জ্বালিয়ে ছেড়ে দেবে। ফলে গণতন্ত্র প্রিয় মানুষেরা, সংবিধান প্রিয় মানুষেরা, দেশকে আমরা যাঁরা ভালবাসি তাঁরা আজ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। ফলে আমার মনে হয় এতে বিশেষ কোনও অসুবিধা হবে না।
লক্ষ্য কী শুধুই বিজেপি হারানো?
বিজেপি এমন একটা সরকার যেটা দেশের জন্য বিশাল বড় বিপদ ডেকে এনেছে। এটার জন্য জোটটা দরকার। এথানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শ কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও দেশের বুকে জ্বলন্ত প্রশ্নগুলো কিন্তু সবার জন্যই এক। এই মুহূর্তে যেভাবে আদানি, আম্বানির হাতে দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে তারই প্রতিবাদে তো আমরা সবাই এক জায়গায় আসছি।
যে অভিযোগগুলি আপনি বিজেপির বিরুদ্ধে তুলছেন সেই একই অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধেও ওঠে। তারপরেও তৃণমূল যখন এই বিরোধী জোটের অংশ হয় তখনও কি মনে হয় আগামী দিনে এই জোটের কার্যকলাপ খুব মসৃণভাবে চলবে?
বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সেখানে থাকা দলগুলি আগামীতে কী করবে সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। কিন্তু, জাতীয় স্তরে একটা বোঝাপড়া হচ্ছে। আর এই জাতীয়স্তরের বোঝাপড়া গোটা দেশে সম্প্রসারিত করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে রাজ্যগুলিতে যে পরিস্থিতি আছে সেটা নিয়েও আলোচনা হবে। রাজ্যে রাজ্যে গণতন্ত্রের যে প্রশ্নগুলি আছে, মানুষের অধিকারের যে প্রশ্নগুলি আছে সেগুলি নিয়ে আগামীতে আমরা আলোচনা করব।
আপনাদের জোট দেখে কি বিজেপি ভয় পাচ্ছে?
অবশ্যই ভয় পাচ্ছে। ওরা তো প্রচার করছিল, মিটিং হবে না। শরদ পাওয়ার আসবেন না। নীতিশ কুমার খুশি নন। এসবও প্রচারও করা হচ্ছিল। অথচ, ২০০৪ সালের পর যে এনডিএ-র কোনও বৈঠক হত না, সেই এনডিএ-কে ওরা এখন জাগিয়ে তুলছে। এক বছর আগে পটনায় জে পি নাড্ডা বলেছিলেন, ভারতে আর কোন আঞ্চলিক দল থাকবে না। থাকবে শুধু বিজেপি। তার এ কথার পরেই তো নীতীশ কুমার ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর ওরা এখন বিপাকে পড়ে এনডিএ কে জাগিয়ে তুলেছে। তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে ওরা কতটা কোণঠাসা হয়েছে। জনগণ যখন একটা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে তারপর তো ওই সরকার ঘাবড়ে যাবেই।
INDIA নামটা কে দিলেন, মমতা না রাহুল? নীতিশের কি সত্যিই অপছন্দ এই নাম?
ওরকমভাবে কেউ নামটা দেননি। আলোচনা থেকেই নামটি উঠে এসেছে। আমরা সবাই মিলে সম্মত হয়েছি। আর তাছাড়া, অনেকে থাকলে একটা নাম নিয়ে একসঙ্গে ঐক্যমত্য গড়ে ওঠে না। তবে সকলেই পছন্দ করেছেন।
INDIA নামটা আপনার কেমন লেগেছে?
এটা তো মিটিং থেকে ঠিক হয়েছে। ঠিকই আছে। নামটা বড় কথা নয়। সময়ের দাবি মেনেই এই নামগুলো ঠিক হয়। আমারও মত ছিল এই নামে। নামটা খুব সহজ। সহজেই সবাই মনে রাখতে পারবে।
বিজেপি বলছে ইন্ডিয়া একটা ঔপনিবেশিক শব্দ। কী বলবেন?
আমাদের সংবিধানের এক নম্বর অনুচ্ছেদ বলছে, “India that is Bharat, is a Union of States.” তাই এ কথার কোনও ভিত্তি নেই। গোটা বিশ্বে তো আমরা ইন্ডিয়া বলেই পরিচিত। বিজেপির এই কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে ওরা সংবিধানকে কতটা তাচ্ছিল্য করে। আসলে ওরা ভয় পেয়েছে এই জোট দেখে।
বাংলায় বৃহত্তম বামপন্থী দল সিপিআইএম। অনেকেই বলছেন এই জোট মাঠ-ঘাটের সিপিআইএম কর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন ‘এলিট’ ইয়েচুরি প্রান্তিক কর্মীদের এই ভাবাবেগ বুঝছেন না! এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? বাংলার কমরেডদের জন্য কী বলবেন?
অবশ্যই বাংলার মাঠ-ঘাট দেখতে হবে। পরিস্থিতি বুঝতে হবে। বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই আছে, থাকবে। কিন্তু, এটাও বুঝতে হবে, দেশ একটা বড় ব্যাপার। দেশের মাঠ-ঘাটটাও তো বুঝতে হবে। তাই সেই প্রশ্নটাও থাকছে। বাংলার বামপন্থীদের কাছে এতে একটু অসুবিধা আছে তা আমি বুঝি। কিন্তু, জাতীয়স্তরের প্রশ্নটাও বুঝতে হবে।
বেঙ্গালুরু বৈঠকে তো কার্যত মধ্যমণি হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবার আগে বলার সুযোগ পেলেন। তৃণমূল সুপ্রিমোর এতটা জাতীয় স্তরে গুরুত্ব দেখে কী বলবেন?
দেখুন, কে কার আগে বা পরে কথা বললেন এ দিয়ে গুরুত্ব বিচারে আমি নারাজ। তবে এ কথা সত্য যে পশ্চিমবঙ্গ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। আর সে রাজ্যের শাসক দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর গুরুত্বও প্রশ্নাতীত। এর বেশি আর কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না।
গত নির্বাচনের আগে আপনাকে অনেকেই তৃণমূলের দালাল বলে কটাক্ষ করেছিলেন। এখন আবার সেই সমালোচনা নতুন করে শুরু হবে না তো?
আমাকে আবার সেটা কেউ বলতেই পারেন। কিন্তু, বাংলার মানুষ এই জোটকে শুধু বাংলার চোখ দিয়ে দেখবে না। দেশের চোখ দিয়ে দেখবে। ফলে দেশের চোখ দিয়ে দেখলে জানবে আজকে বিজেপিকে পরাজিত করা গেলে আগামীতে তৃণমূলকেও পরাজিত করা যাবে।