আপনারা ম্যানিকুইন দেখেন তো দোকানে… সব তো কালোই হয়: পরমা ঘোষ

স্বরলিপি ভট্টাচার্য |

Feb 15, 2021 | 1:07 PM

সরস্বতী কি বন্ধু? তাকে সাজাতে গেলে কেমন স্টাইল করবেন পরমা? অথবা বাড়ির শ্যামা মেয়েটিকে কি সরস্বতী পুজোর নতুন কালেকশনে মডেল হিসেবে বেছে নেবেন? এ হেন প্রশ্ন দিয়ে সাজানো ছিল আড্ডা। মনখোলা উত্তর দিলেন পরমা।

আপনারা ম্যানিকুইন দেখেন তো দোকানে... সব তো কালোই হয়: পরমা ঘোষ

Follow Us

‘স্টোরিজ় অন ফ্যাবরিক’।
তাঁর ইন্সটাগ্রাম বায়ো (Bio)-র প্রথম লাইন। যিনি ‘ফ্যাবরিক’-এ ‘স্টোরিজ়’ আঁকেন, তাঁর নিজের জীবনটাও গল্পের মতো… যা ‘গল্প হলেও সত্যি’।
তিনি ডিজ়াইনার পরমা ঘোষ। উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে আইন নিয়ে পড়াশোনা। পেশাদার আইনজীবি হিসেবে ১০ বছরের সফল কেরিয়ার। তারপর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ফ্যাশন ডিজ়াইনিং শুরু করেন। গত ছ’ বছর ধরে এই পেশাতেও সমানভাবে সফল তিনি। কাল, সরস্বতী পুজো। সরস্বতী কি বন্ধু? তাকে সাজাতে গেলে কেমন স্টাইল করবেন পরমা? অথবা বাড়ির শ্যামা মেয়েটিকে কি সরস্বতী পুজোর নতুন কালেকশনে মডেল হিসেবে বেছে নেবেন? এ হেন প্রশ্ন দিয়ে সাজানো ছিল আড্ডা। মনখোলা উত্তর দিলেন পরমা।

ছোটবেলার সরস্বতী পুজো দিয়ে শুরু করতে চাইব, বাসন্তী রঙেই কি সাজতেন?

আমার স্কুল ছিল গোখেল মেমরিয়াল গার্লস স্কুল। ব্রাহ্ম স্কুল। ফলে পুজো হত না। তবে বাড়িতে বড় করে সরস্বতী পুজো হত। পাড়াতে আমাদের বাড়িতেই সব থেকে বড় করে হত। তাই স্কুলে হত না বলে কিছু মিস করিনি। সরস্বতী পুজোর দিন সাদা বা হলুদই পরতাম। আমি অনেক জায়গাতেই পাথ-ব্রেকিং জিনিস করি। কিন্তু আমার মনে হয়, কিছু-কিছু ট্র্যাডিশন এক রকম থাকলেই ভাল। যেমন আমার বিয়ের বেনারসি ছিল টকটকে লাল। কিছু জিনিস সাবেকি হলেই ভাল লাগে। ব্লাউজ়ে কায়দা করতে পারি। কিন্তু শাড়ির ক্ষেত্রে কালার প্যালেটে স্টিক করে থাকতাম।

সরস্বতীর স্টাইলাইজ়েশনের দায়িত্ব আপনার উপর থাকলে কীভাবে সাজাবেন?

আমার প্রথম ডিজাইন পলাশ ফুল। পলাশ ডিজাইন। অনেকে বলেছেন, আমি করার আগে এত মন দিয়ে পলাশ লক্ষ্যই করেননি। এত ফুটে থাকে রেড রোডের ধারে… আমার লোগোটাও পলাশ ফুল দিয়ে করা। প্রথম পলাশ ফুল নোটিস করেছিলাম সরস্বতীর দোয়াতের পাশে রাখা থাকত, সেটা দেখে। অসম্ভব আকৃষ্ট করেছিল। তখন আমি শান্তিনিকেতনেও যাইনি। পুরুলিয়াতেও যাইনি। কোনওদিন রেড রোডের ধারে পলাশের গাছও দেখিনি। দোলের সময় শান্তিনিকেতন গেলে পলাশের মালা পরে থাকত অনেকে, ওইটুকুই দেখা। আমি সরস্বতীকে সাজালে শাড়ি পরাব। আর শাড়ি, ব্লাউজ় দু’টোতেই পলাশ ফুল থাকবেই।

সরস্বতী পুজোর জন্য তৈরি পরমার নতুন ডিজাইন। ছবি সৌজন্য: পরমা ঘোষ।

সরস্বতীর সঙ্গে পলাশকে মেলাবেন কীভাবে?

সরস্বতী বরাবরই আমার প্রিয় ঠাকুর, কারণ দু’দিন পড়াশোনা করতে হত না। আর অন্যান্য অ্যাক্টিভিটি জড়িত থাকে এই পুজোর সঙ্গে। ফলে ব্রাইট, আনন্দের বিষয়টাও সাজে রাখতে হবে। পলাশে কোনও গন্ধ নেই। অথচ পাওয়ারফুল প্রেজ়েন্স আছে। সেটার সঙ্গে সরস্বতীর মিল পাই। লোকে বলে লক্ষ্মী চঞ্চলা, অনেক তুষ্ট করে রাখতে হয়। সরস্বতীর এত কিছু ব্যাপার নেই। দেখেই মনে হয় শান্তশিষ্ট ঠাকুর।

কখনও মনে হয়েছে, লক্ষ্মী মানে ঘরের বউ, আর সরস্বতী সেই মেয়েটা যে আগে বন্ধু হতে পারে?

আসলে এটা বোধহয় নির্ভর করে আমাদের দেখার উপর। অর্থাৎ কোন বয়সের মানুষ পুজো করেন, সেটার জন্যই বোধহয় এই মানসিক ভাগটা হয়ে যায়। লক্ষ্মী পুজো বিবাহিতরা করেন। আর সরস্বতী পুজো করে টিনএজাররা। সেজন্যই বোধহয় আমাদের এই মানসিক বিভেদটা হয়ে যায়। কিন্তু আমার বাবা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, সরস্বতী ঠিক থাকলে লক্ষ্মীও ঠিক থাকবে। আমি মনে করি, কারও পড়াশোনা, মনন, ভাবনাটা যদি ঠিক হয়, তাহলে বাকিটা হয়ে যাবে। আমি যেহেতু ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়িনি, তাই হয়তো ট্রেন্ড ডিজ়াইনারদের থেকে অনেক জায়গায় পিছিয়ে রয়েছি। কিন্তু ভাবনাটা ঠিক থাকলে লক্ষ্মী উইল ফলো সরস্বতী। টাকাপয়সা তখনই ঠিক থাকবে, যখন সরস্বতী ঠিক থাকবে। লক্ষ্মীকে ধাওয়া করতে গিয়ে যেন সরস্বতী অচল না হয়।

পরমার ডিজাইনে মডেলদের সাজ। ছবি সৌজন্য: পরমা ঘোষ।

একই বাড়ির দু’টি মেয়ে। ধরা যাক, একজন ফর্সা। আর একজন শ্যামবর্ণা। সরস্বতী হিসেবে সাজাতে চাইলে মডেল কোন মেয়েটিকে করবেন?

দেখুন, সরস্বতী তো মনের। আমি সরস্বতী পুজোয় বারবার হলুদ শাড়ির কথা বলেছি। কিন্তু ত্বকের রং গুরুত্বপূর্ণ নয়। ধরুন, মাটির মূর্তি না তৈরি করে পিতলের বা কাঠের মূর্তি তৈরি করলেই তার মধ্যে রং থাকে না। কিন্তু সেটাও তো সরস্বতী রূপেই পুজো করি আমরা। দু’টি মেয়ের মধ্যে যাকে দেখে মনে হবে তার স্থিরতা রয়েছে, কথাবার্তায় বুদ্ধির ছাপ রয়েছে, আমার কাছে সেই-ই সরস্বতী। আপনার এই প্রশ্নটা শুনে একটা ঘটনা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে…

প্লিজ বলুন…

আমার এক ক্লায়েন্ট মেয়ের জন্য হাতেখড়ির শাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন কয়েক দিন আগে। যখন হলুদ পলাশ শাড়ি দেখাচ্ছি, উনি বলছেন, মেয়ের রং কালো। এত হলুদ ভাল লাগবে না। আপনি অন্য কোনও রং দিয়ে দিন। আমি মেয়ের ছবি দেখতে চাই। রং একটু শ্যামলার দিকেই। তখন আমি বললাম, “আপনি চাইলেও অন্য কোনও রং আপনাকে বিক্রি করব না, আপনি কিনলে এটাই নিতে হবে। আপনি মা হয়ে যদি এটা মনে করেন, সারা জীবন ওর কাঁধে কী চাপাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন? আপনার ইচ্ছে না করলেও ডিজাইনার হিসেবে আমি বলছি, আপনি কিনুন।” উনি ওটাই কিনেছেন।

নিজের শর্তে জীবন বাঁচতে ভালবাসেন পরমা।

গায়ের রং নিয়ে সত্যিই এমন কনসেপ্ট রয়েছে আজও…

ঠিকই। কিন্তু আপনারা ম্যানিকুইন দেখেন তো দোকানে… সব তো কালোই হয়। তার উপর জামা পরানো থাকে। লোক তো দোকানে জিনিস বিক্রির জন্যই রাখে, খারাপ হলে তো কালো ম্যানিকুইনের উপর জামা পরানো থাকত না।

ত্বক ঈষৎ চাপা হলে হলুদ রং মানায় না, এটা তাহলে মিথ বলছেন?

দেখুন, কালো রঙের উপর পোশাকের রং আরও খোলে। গায়ের রং কালো হলে হলুদ পরালে আরও কালো লাগবে, এটা অনেকে মনে করেন। আবার আমি শুনেছি আগেকার দিনে কনে দেখতে আসলে মেয়েদের হলুদ শাড়ি পরানো হত, যাতে উজ্জ্বল হয় রং। এটাও মিথ। আমি সব রকম রং দিয়ে জামা তৈরি করি। আমি চাই, সবাই সব রকম জামা পরুক।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।

Next Article