
অভিষেক সেনগুপ্ত
বাড়ির সামনে একফালি জায়গা। সাধারণত যাতায়াতের জন্য ব্যবহার হয়। অনেক সময় প্লাস্টিকের টেবল-য়েচার পেতে বসেন বাড়ির লোকজন। যদি ওই জায়গা কৃত্রিম ঘাস আর নেটে মোড়া দেখেন, জানবেন আপনি সরফরাজ খানের বাড়িতে পৌঁছ গিয়েছেন! ব্যাট আর বলের সঙ্গে সারা দিনের সম্পর্ক। যখন ইচ্ছে তখনই যাতে নেমে পড়তে পারেন, তার জন্য বাবা নৌসাদ খান সব সাজিয়ে রেখেছেন। ওই একফালি পিচ দেখার জন্য সোমবার বিকেলে বোধহয় ভিড় উপচে পড়েছিল মুম্বইয়ের ওই বাড়িতে। পরিশ্রমের ফল মেলে বলে? না, কেউ কেউ হেরে যাবেন না বলেই ক্রিকেট মাঠে আসেন বলে! বঞ্চনা ঠেলতে ঠেলতে সরফরাজ খান অবশেষে জায়গা করে নিয়েছেন ভারতের টেস্ট টিমে। বিশাখাপত্তনম টেস্টে তাঁর অভিষেকও হচ্ছে, বলেই দেওয়া যায়। এই সরফরাজের লড়াইয়ের গল্প সিনেমাকে হার মানাবে।
কার্যত বস্তি থেকে উঠে আসা। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। আজাদ ময়দানে চলে যাওয়া। প্র্যাক্টিস, ম্যাচ খেলা, আবার প্র্যাক্টিস। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা এই নিয়মের হেরফের হয়নি কখনও। মাত্র ১২ বছর বয়সে সরফরাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতিভাবান এক ক্রিকেটারের জন্ম হতে চলেছে মুম্বইয়ে। হ্যারিস শিল্ডে রিজভি স্প্রিংফিল্ড স্কুলের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৩৯ রানের রেকর্ড করেছিলেন। এরপর যতটা সহজ হয়েছিল, ততটা হয়নি। বরং প্রতিবন্ধকতা ঠেলতে ঠেলতে ভারতের টেস্ট টিমে এসে পৌঁছেছেন সরফরাজ। মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলবেন, এই স্বপ্ন নিয়েই বড় হচ্ছিলেন। টিমে এলেন, কিন্তু সুযোগ মিলছিল না। ২০১৫ সালে ঠিক করেন, মুম্বই ছেড়ে উত্তরপ্রদেশ চলে যাবেন। ওই টিমের হয়েই খেলবেন রঞ্জি। গেলেন বটে, কিন্তু কাজে লাগল না। আবার ফিরলেন মুম্বইয়ে। এ বার সুযোগ পেলেন। ততদিনে বিরাট কোহলির আরসিবি থেকে বাদ পড়েছেন। ফিট নন, এই অভিযোগে। অনেকেই আড়ালে আবডালে ‘মোটা’ বলতে শুরু করেছেন। বরাবরের মতো প্রিয় ব্যাটই সাহস করে তুলে ধরেছেন নিজেকে চেনানোর জন্য।
এক ইন্টারভিউতে সরফরাজ বলেছেন, ‘স্কুল ক্রিকেটে রান করেছি প্রচুর রান করেছি। লোকাল ক্রিকেটেও নিজেকে প্রমাণ করেছি। মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না তাও। তাই উত্তরপ্রদেশ চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানেও তেমন সুবিধা হল না। আবার মুম্বইয়ে ফিরেছিলাম। ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল, মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে যদি সুযোগ পাই, ফাইনালে সেঞ্চুরি করব। কিন্তু কবে সেই সুযোগ পাব, তা জানতাম না। কিন্তু পেয়েওছিলাম। আসলে হার্ডওয়ার্ক করে গিয়েছি। প্রচুর পরিশ্রম করেছি, তারই ফল মিলেছে।’
বাবা নৌসাদ খান না থাকলে হয়তো এতদূর আসা হত না তাঁর। সরফরাজ বলেও দিচ্ছেন, ‘বাবার জন্যই এতদূর আসতে পেরেছি। ৬ বছর বয়সে মাঠে নিয়ে যায় বাবাই। কোচিংও করাতে শুরু করে। অনেক সময় মনে হয়েছে, আর এগোতে পারব না। কিন্তু বাবা আবার মোটিভেট করে মাঠে ফিরিয়েছে। একটা সময় বাবা ক্রিকেট কোচিং করত। এক সময় কোচিং ছেড়ে শুধু দুই ছেলেকেই কোচিং করানো শুরু করেন। বাবার অবদান ভুলতে পারব না।’
কী করলে ভারতীয় টিমে সুযোগ পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর এক সময় হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেছেন রঞ্জি ক্রিকেটে। ডাবল, ট্রিপলও করেছেন। তাতেও ডাক পাননি। ভারতীয় এ দলেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাঁর যাত্রা। ঠিক সেই সময়ই সরফরাজ খুঁজে পেলেন তাঁর দিশা। অবশেষে উত্তরণ হল ভারতীয় টিমে। মুম্বইয়ের রঞ্জি টিমের পার্টনার সূর্যকুমার যাদব পর্যন্ত বলেছেন, ‘এ বার উৎসব শুরু হবে।’
উৎসবই তো চান। এতদিন যা করেছেন মুম্বইয়ের হয়ে, দেশের হয়ে করতে চান তাই। শুধু অপেক্ষা টেস্ট অভিষেকের। বিশাখাপত্তনমের জন্য তৈরি হচ্ছেন সরফরাজ খান।