প্রান্তিক দেব
বাংলায় একটা কথা খুব প্রচলিত, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। কয়েক বছর আগে বিশ্ব ফুটবলেও এই প্রবাদকে উল্টে-পাল্টে ব্যবহার করা হল, লাগে ফুটবলার দেবে…। প্রশ্ন করতেই পারেন, বিশ্ব ফুটবলে আবার কুমোরটুলি তৈরি হল কবে? আছে স্যার, আছে। যেমন চাই তেমন ফুটবলার পাওয়া যাবে। ফরোয়ার্ড চাইলে ফরোয়ার্ড, মিডিও চাইলে মিডিও, ডিফেন্ডার চাইলে ডিফেন্ডার। গত কয়েক বছর আগেও নিয়মিত ফুটবলার সাপ্লাই দিত এই কারখানা। মাঝে একটু ভাঁটা পড়েছিল, এই যা। তবে এ বারের ইউরো কাপ বলছে, ফুটবলার তৈরির কারখানায় আবার ভালো প্রোডাক্ট তৈরি হতে শুরু করেছে। ট্রেলারে তেমনটাই দেখে গিয়েছে। ২০২৪ ইউরো কাপে অনেক ফুটবলারের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়েছে। টনি ক্রুজ, টমাস মুলার, পেপে, লুকা মদ্রিচ। এমন হেভিওয়েট নামের বিকল্প কেউ আছে কী? আছে। ইয়ামাল, নিকো উইলিয়ামস, ওলমো, জাভি সিমন্সের দিকে লক্ষ্য রাখছেন কি?
১৬ বছরের ইয়ামাল এ বার বেশ নজর কেড়েছেন। মেসির কোলে তাঁর একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে। ২০০৭ সালে পুঁচকে ইয়ামালের সঙ্গে লিও। ২০২৪ সালে দুজনেই ট্রফির সামনে দাঁড়িয়ে। একজন ইউরোয়, একজন কোপায়। আরও একটা মিল আছে দু’জনের। ১৯ নম্বর জার্সি। মেসি ১৯ নম্বর জার্সি পরে শুরু করেছিলেন আন্তর্জাতিক কেরিয়ার। ইয়ামালও তাই। আরও আছে। দু’জনেই বিশ্ব ফুটবলের কুমোরটুলিতে তৈরি। বার্সেলোনার লা মাসিয়া অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা। বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় খামার বাড়ি। মেসি, ইয়ামাল, ওলমো, জাভি সিমনসরা এই খামার বাড়ি থেকেই স্বপ্নের দৌড় শুরু করেছেন। নাম গুনতে শুরু করলে শেষ করা যাবে না। পেপ গুয়ার্দিওলা থেকে কার্লোস পুয়োল। জাভি থেকে ইনিয়েস্তা। বুসকেট্স থেকে ফ্যাব্রেগাস। জর্ডি আলবা থেকে কলকাতায় খেলে যাওয়া ভিক্টর ভাস্কুয়েজ। এঁরা লা মাসিয়া থেকে বিশ্ব ফুটবলের তারকা হয়ে উঠেছিলেন। মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার পর থেকেই কাতালান ক্লাবের অধঃপতন শুরু। লা মাসিয়াও নিজের ছন্দ হারায়। আর বিশ্ব ফুটবলেরও খরা। এই অবস্থায় হাল ধরলেন এক প্রাক্তনী। বলতে পারেন শিল্পীর হাতেই আরও ঝকঝকে হয়ে উঠল শিল্প। তাঁর নাম জাভি হার্নান্ডেজ।
২০২১ সালে বার্সেলোনার ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই নিজের ছেলেবেলায় ফিরে যান জাভি। ঝিমিয়ে পরা লা মাসিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তোলেন। যতটা সময় দিয়েছিলেন বার্সেলোনা সিনিয়র দলকে, তার থেকে কোনও অংশে কম দেননি লা মাসিয়াকে। তার ফলটা এ বার পাওয়া যাচ্ছে হাতে নাতে। ইউরো কাপে ইয়ামাল, ওলমো, সিমন্সদের মতো প্রতিভারা সাড়া ফেলে দিয়েছেন। দেশীয় জার্সিতে যেন ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন নিজেদের। অন্য দিকে, লা লিগায় ছাপ রাখতে শুরু করেছেন মিডফিল্ডার গাভি, ফুলব্যাক আলেকজেন্ডার বাল্দে, মিডফিল্ডার ফির্মিন লোপেজরা। কে কত দুর যাবেন, এখনই বলা সম্ভব নয়। চোট আঘাত থেকে পেশাদারি চাপ, বিড়ম্বনা হতেই পারে। এই যেমন কলকাতায় খেলে যাওয়া ভিক্টর ভাসকুয়েজের কথাই ধরুণ। মেসিদের সময় অ্যাকাডেমির সেরা ছাত্র ছিলেন ভিক্টর। কিন্তু সিনিয়র কেরিয়ারে চোটের ধাক্কা ঠেলে এগোতেই পারেননি।
একটা ফুটবল ম্যাচ জিততে গেলে স্টিস্টেম লাগে, ফর্মেশন দরকার পড়ে। লা মাসিয়াও একটা সিস্টেম। যে সিস্টেম বেশ কিছুদিন থমকে ছিল। আবার ঘুরতে শুরু করেছে চাকা। ফুটবলার তৈরির কুমোরটুলিতে কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজ আবার শুরু হয়েছে। মেসি-রোনাল্ডো যুগের পরের তারকা পেতে ফুটবলের কুমোরটুলি সচল থাকা যে খুব খুব প্রয়োজন!