
অন্বেষা বিশ্বাস
‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’ এই মুহূর্তে ‘বহুদূর’ থেকেই ভেসে এসেছে সাবধানবাণী, যা আবারও জন্ম দিতে পারে এক ‘তর্ক’-এর। সেই ‘তর্ক’ কতটা ‘বিশ্বাস’যোগ্য, সে প্রশ্ন আপাতত তোলা থাক। সাবধানবাণীতে কাজ হবে কি না, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। ‘তর্ক’ সৃষ্টি হয়েছে যে তথ্যকে কেন্দ্র করে তা হল (একটি চিনা দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী): উহান ইনস্টিটিউটে কর্মরত ভাইরোলজিস্ট শি ঝেংলি (Shi Zhengli) ওরফে ‘ব্যাটওম্যান’ ও তাঁর দল 40 রকম প্রজাতির করোনাভাইরাসের মূল্যায়ন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ফের নতুনরূপে ছড়াতে পারে এই মারণ-জীবাণু। আর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয়ে গিয়েছে খোঁজ। কে এই শি ঝেংলি, বিজ্ঞান জগতে যাঁর পরিচিতি ‘ব্যাটওম্যান’ হিসেবেই বেশি?
এমন নামের কারণ কী?
2020 সালে করোনা যখন সবেমাত্র অতিমারির রূপ ধারণ করছে, তখনই ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন এই ‘ব্যাটওম্যান’: আপনি-আমি যা দেখছি, তা আসলে ‘হিমশৈলের চূড়া মাত্র।’ এহেন চিনা ভাইরোলজিস্ট শি ঝেংলি ও তাঁর বাহিনির সাম্প্রতিকতম কাজের খবরই আবারও দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলতে শুরু করেছে বিশ্ববাসীকে। তাঁর দাবি, এই বিশ্ব আরও একটি মারাত্মক করোনা-অতিমারির মুখোমুখি হতে চলেছে। উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি-র প্রধান ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ঝেংলি বাদুড় ভাইরাস কীভাবে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তা নিয়ে গবেষণা করেন। অর্থাৎ তিনি বাদুড় নিয়ে গবেষণা করেন, এ কথা বললে ভুল কিছু বলা হবে না। মূললত এই বাদুড়-ঘনিষ্ঠতার কারণেই ঝেংলিকে ‘ব্যাটওম্যান’ বলা হয়। 26 সেপ্টেম্বর থেকে তাঁকে নিয়ে আবারও আলোচনা তুঙ্গে। সৌজন্যে চিনা দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন।
‘গায়েব’ হওয়া ‘ব্যাটওম্যান’কে কেন্দ্র করে এত আলোচনা কেন?
The New York Times-এর প্রতিবেদন আনুযায়ী, গবেষণায় জানা গিয়েছে, করোনাভাইরাস আবারও নতুন রূপে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট (এসসিএমপি)-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি (ডব্লিউআইভি)-এর শি ঝেংলি ও তাঁর সহকর্মীরা 2023 সালের জুলাই মাসে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। আর সেখানে তারা 40টি ভিন্-ভিন্নন করোনভাইরাসের প্রজাতি খুঁজে পেয়েছেন। আর তারপর সেগুলি পরীক্ষা করে দেখেছেন, কোন প্রজাতিটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাঁরা যে 40টি প্রজাতি নিয়ে কাজ করছিলেন, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আক্ষরিক অর্থেই ‘বিপজ্জনক’ প্রজাতির। গবেষণা মোতাবেক, এই 40টি ভাইরাসের মধ্যে 6টি ভাইরাস এমন রয়েছে, যা মানুষের মধ্যে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। 3টি ভাইরাস কুকুর, বিড়াল এই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে। ভবিষ্যতে আবারও করোনার মতো আরেকটি ভাইরাস আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন শি ঝেংলি ওরফে ‘ব্যাটওম্যান’। এ তো গেল গবেষণার কথা। ‘ব্যাটওম্যান’-কে কেন্দ্র করে এত আলোচনা কেন?
দলের প্রধান গবেষক…
করোনা ভাইরাস যখন হু-হু করে ছড়াচ্ছে 2020-তে, সে সময় ঝেংলির ‘গায়েব’ হওয়াকে কেন্দ্র করে জল্পনা তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞানী মহলে। একাধিক রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছিল, ঝেংলি তাঁর গবেষক দলের সঙ্গও ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম AP-র কাছে তিনি এই জল্পনাকে আপাদমস্তক ‘মিথ্যে’ বলে দাবি করেছিলেন। প্রমাণস্বরূপ তিনি তাঁর উইচ্যাট অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা 9টি ছবি দেখান। শুধু তাই-ই নয়, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (AP) রিপোর্ট অনুযায়ী, 2020 সালের মে মাসের শেষ দিকে এই ভাইরোলজিস্টকে চিনের টেলিভিশন চ্যানেল CGTN-এর একটি সাক্ষাৎকারেও দেখা গিয়েছিল। যেখানে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগের সরাসরি উত্তর দিয়েছিলেন। ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি (WIV) থেকেই কোভিড-19 ছড়িয়েছিল। ঝেলিং সেখানে বাদুড় নিয়ে গবেষণা করতেন এবং সেই গবেষক দলের প্রধান গবেষক ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, উহানের এক ল্যাবে বহু বছর ধরেই এসব—মূলত বাদুড় এবং বাদুড়ের দেহের নানাবিধ ভাইরাস—নিয়ে গবেষণা চলছে। আর তা থেকেই এই করোনার জীবাণু গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ঝেংলি এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছিলেন, 2019 সালের 30 ডিসেম্বর প্রথম করোনা ভাইরাসের স্যাম্পেল পান তিনি। এহেন বিতর্কিত ‘ব্যাটওম্যান’-এর পড়াশোনা কোথায়?
ঝেংলি 1964 সালে হেনান প্রদেশের নানয়াংয়ের জিক্সিয়া কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। 1987 সালে উহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক্সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ঝেংলি। 1990 সালে চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস (CAS)-এর উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি (Wuhan Institute of Virology of the Chinese Academy of Sciences) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর এক দশক পর, অর্থাৎ 2000 সালে ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ার 2 বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন। সেই সময় তিনি ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। 2004 সালে যখন SARS (সিভিয়ার অ্যাকুইটি রেসপিরেটরি সিনড্রোম-সার্স) ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটে, তখনই বাদুড়ের প্রতি আসক্তি তৈরি হয় তাঁর। বাদুড় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন ঝেংলি। 2011 সালে, তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম চিনের একটি গুহায় বাদুড় খুঁজে পেয়েছিলেন। আর তারপর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, সেসব বাদুড়ই SARS ভাইরাস বহন করছে।
The New York Times-এর প্রতিবেদন আনুযায়ী, এর 6 বছর পর, 2017 সালে, উহান ল্যাবে ঝেংলি ও তাঁর সহকর্মীরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই গবেষণাপত্র বলছে, তাঁরা নতুন ‘হাইব্রিড ব্যাট করোনাভাইরাস’ তৈরি করেছিলেন ল্যাবে। তার মানে কৃত্রিম ভাইরাস? কেন? ঝেংলি ও তাঁর সহকর্মীরা দেখার চেষ্টা করছিলেন, সেসব ভাইরাস মানবদেহে কতটা ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ওই ভাইরাসগুলির মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি ভাইরাস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যা, আক্ষরিক অর্থেই মানব কোষে প্রবেশ করে ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। যদিও পরবর্তীতে সেই গবেষণাকে কেন্দ্র করে তাঁরা আর কিছু জানাননি।
‘হাজার-হাজার ডক্টর হাজরা’
তবে 2019 সালের মার্চ মাসে, ঝেংলি একটি জার্নাল প্রকাশ করেছিলেন। সেই জার্নালেই বড়-বড় করে ছাপা হয়েছিল একটি প্রতিবেদন: ‘ব্যাট করোনাভাইরাস ইন চায়না’। সেখানে তিনি সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, “ভবিষ্যতে SARS বা MERS-এর মতো করোনাভাইরাস ছড়িয়ে সম্ভাবনা খুব বেশি। আর তা হবে বাদুড় থেকেই। এমনকি তা চিনেও ছড়াতে পারে। এই 2023-এ বসে পিছনে ফিরে তাকালে কি এখন মনে হচ্ছে, এভাবেই তো 2019 থেকে 2020-তে ঘটে গিয়েছিল একের পর এক ঘটনা। সারা বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছিল SARS বা MERS-এর মতো করোনাভাইরাসের প্রজাতির। এবার ফের 2023 সালে এসে বিশ্ববাসীকে সতর্কবার্তা দিলেন 59 বছর বয়সী ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়া সেই ‘ব্যাটওম্যান’। উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি-র এই বিজ্ঞানী ও তাঁর দলবল চিনের আশপাশ থেকে এখনও পর্যন্ত 10,000-এরও বেশি বাদুড়ের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ‘হাজার-হাজার ডক্টর হাজরা’-র মতো দশ হাজারেরও বেশি বাদুড়ের নমুনা সংগ্রহকারী গবেষক দলের মাথাকে ‘ব্যাটওম্যান’ বললে তাই অত্যুক্তি হয় না মোটেই।