Mamata Banerjee: ‘অনীত থাপা বন্ধু, ওদের সঙ্গে ঝগড়া নয়’, সভামঞ্চেই সাংসদকে ‘ধমক’ মমতার

North Bengal: মঙ্গলবারও, কার্শিয়াঙে দেখা গেল প্রশাসনিক বৈঠকেও উপস্থিত রয়েছেন অনীত থাপা। আগেরদিনের মতো এদিনও দেখা যায়নি বিমল গুরুঙ  ও বিনয় তামাংকে

Mamata Banerjee: 'অনীত থাপা বন্ধু, ওদের সঙ্গে ঝগড়া নয়', সভামঞ্চেই সাংসদকে 'ধমক' মমতার
সাংসদ শান্তা ছেত্রীকে ধমক তৃণমূল সুপ্রিমোর, নিজস্ব চিত্র
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 26, 2021 | 3:52 PM

দার্জিলিঙ:  উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। মঙ্গলবার কার্শিয়াঙে প্রশাসনিক বৈঠকে সরাসরি নিজের দলের সাংসদকেই ধমক দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। পাহাড়-নেতা অনীত থাপার (Anit Thapa) সঙ্গে ঝগড়া নয়, এমনটাই স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন মমতা। পাশাপাশি, পাহাড়ে উন্নয়ন নিয়ে বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

পাহাড়-রাজনীতি চিরকালই যেন ‘গাভীর মতো চরে’। শৈলরানির আবহাওয়া কেবল খামখেয়ালি নয়, রাজনীতিও রঙিন। সেই ছবিই যেন আরও স্পষ্ট হল। রবিবারেই শিলিগুড়ির বিজয়া সম্মিলনীতে উপস্থিত হয়েছিলেন অনীত থাপা। মঙ্গলবারও, কার্শিয়াঙে দেখা গেল প্রশাসনিক বৈঠকেও উপস্থিত রয়েছেন অনীত থাপা। আগেরদিনের মতো এদিনও দেখা যায়নি বিমল গুরুঙ  ও বিনয় তামাংকে।

সভামঞ্চেই, অনীত থাপার পক্ষে সুর তুলে তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, “অনীত থাপা আমাদের বন্ধু, ওঁদের সঙ্গে ঝগড়া নয়”। এরপরেই নিজের দলের সাংসদ শান্তা ছেত্রীকে ধমক দিয়ে বলেন, “শান্তা, দলের একটা ডিসিপ্লিন রয়েছে। অনীতদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। তুমি সুব্রতর সঙ্গে এ ব্য়াপারে একবার দেখা করবে। পাহাড়ের সকলে আমাদের বন্ধু।”

এখানেই থামেননি তৃণমূল নেত্রী। আরও বলেন, “আমরা পাহাড়ের কারোর সঙ্গে ঝগড়া করব না। ওরা সকলেই আমাদের বন্ধু। পাহাড়ে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে চাই না।”

গতকালই, পাহাড়ের দলীয় কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে চিঠির মাধ্যমে তোপ দেগেছেন তৃণমূল সাংসদ শান্তা ছেত্রী। তিনি অভিযোগ করেন, দলের কিছু কর্মী ইচ্ছে করে তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দূর্নীতির অভিযোগ তুলে বদনাম করার চেষ্টা করছে। অথচ, তাঁরাই গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় দলবিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিলেন। তৃণমূল সভাপতি সুব্রত বক্সির কাছে এই মর্মেই  চিঠি পাঠান শান্তা।

সেই প্রসঙ্গেই, তৃণমূল সুপ্রিমো কার্শিয়াঙের সভা থেকে রাজ্যসভার সাংসদকে সরাসরি বলেন, “আমাদেরকে দিয়ে অনেকই অনেক কিছু বলিয়ে নিতে চাইবে। তা বলে কী আমরা বলে দেব। অনীতের বিরুদ্ধে কোনও স্টেটমেন্ট দেবে কেন? এত ধর্না দেবার কথাই বা আসছে কোত্থেকে! এরকমভাবে ঝগড়া করবে না। কেউ কিছু বললে বলবে ‘আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতে চাই। পাহাড়ের উন্নয়ন চাই।’ ” তৃণমূল নেত্রীর এই মন্তব্য যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ  বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।

রবিবার বিজয়া সম্মিলনীতে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল অনীত থাপাকে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি আমন্ত্রণ পেয়েই এখানে এসেছি। বাকিরা কেন আসেননি, বা তাঁরা আমন্ত্রণ পেয়েছেন  কি না আমি জানি  না। তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কখনও অসদ্ভাব নেই। তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলব বলেই আমি এখানে এসেছি। পাহাড়ের উন্নয়নই আমার মূল লক্ষ্য।” এখানেই থামেননি অনীত। তিনি আরও যোগ করেন, “পাহাড়ে জিটিএ নির্বাচন আটকে রয়েছে। সেই নির্বাচন যাতে আরও দ্রুত গতিতে হতে পারে সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।”

মঙ্গলবার, এ বার অনীত থাপার পক্ষে খোদ দলের সাংসদকে তৃণমূল সুপ্রিমোর ‘শাসনের’ ঘটনায় সমীকরণ বদলের ইঙ্গিত বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। পাশাপাশি, জিটিএ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও যে বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তৃণমূল সুপ্রিমো এমনটাই অনুমান। নির্বাচন আবহেও মুখ্য়মন্ত্রী তাঁর ‘পাহাড় বন্ধুদের’ জন্য তিনটি আসন ছেড়েছিলেন। এ বার, সরাসরি সভামঞ্চেই ‘পাহাড়বন্ধু’ অনীত থাপার পক্ষে মন্তব্য করায় পাহাড়ে যে ফের ঘর গোছাতে ইচ্ছুক তৃণমূল এমনটাই যেন ইঙ্গিত দিলেন তৃণমূল নেত্রী।

এদিকে, গত সেপ্টেম্বরেই পৃথক দল ঘোষণা করেছেন অনীত থাপা। সাংবাদিক বৈঠক করে অনীত বলেছিলেন, “পাহাড় সমস্যার সমাধান কোনও দলই করতে পারেনি। পাহাড়ের উন্নয়ন নিয়ে কেউ চিন্তা করেনি। সেই কথা মাথায়  রেখেই নতুন দল গড়তে চলেছি। এই বছরের সেপ্টেম্বরেই নতুন দলের নাম ঘোষণা করব। আমাদের দল পাহাড়ের কথা বলবে। পাহাড়ের মানুষের কথা, তাঁদের উন্নয়নের জন্য চিন্তা করবে।” তাহলে, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার রাশ কি পুরোপুরি বিমলের হাতেই তুলে দিলেন অনীত? যদিও, এদিন সে প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

যে অনীত বলেছিলেন কোনও রাজনৈতিক দলই পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, সেই অনীতকেই খোদ তৃণমূল সুপ্রিমোর সভায় উপস্থিত হতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। তাহলে কি কোনওভাবে তৃণমূলের সঙ্গে ‘হাত ধরেই’ চলতে চায় অনীত থাপার স্বতন্ত্র দল? এদিকে, পাহাড়ে কার্যত ভেঙে গিয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। পৃথক দল গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিনয় তামাং। মোর্চার ভার কার্যত তুলে দিয়েছেন বিমল গুরুঙের হাতে।

এই রোদ, এই মেঘে ঢাকা। এই বৃষ্টি তো এই বরফ। ‘পাহাড়-কি-রানির’ আবহাওয়ার মতোই খামখেয়ালি রাজনীতি। ২০০৭ থেকে ২০২১, চোদ্দো বছরে পাহাড় রাজনীতিতে ঘটেছে অনেক পটপরিবর্তন। কিছুদিন আগেই, সমস্ত ‘শীতলতা’ পরিত্যাগ করে প্রায় ঘণ্টাতিনেকের রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিমল গুরুঙ্গ ও বিনয় তামাং। বৈঠক শেষে বিনয় বলেছিলেন, “পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য  কোনও রাজনৈতিক দলই কাজ  করেনি। আমরা পাহাড়ের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত। তারজন্য় যা যা করতে হয় সব পদক্ষেপ করতে রাজি। আমাদের বৈঠকেও পাহাড়ের সমস্যা নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।”

বিনয়-বিমলের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যে ‘সম্প্রীতির’ ছবি প্রকাশ্যে আসে তাতে স্পষ্ট অন্তর্বিভেদ না মিটলেও দলের ভাঙন রোখার ‘আশঙ্কা’ থেকেই এই পদক্ষেপ দুই নেতার। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী সহ শীর্ষ তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে দেখা করবেন বিমল ইঙ্গিত ছিল এমনটাই। অন্যদিকে, ‘দিদির’ সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেনি বলেই দাবি করেছিল অনীত শিবির। এমনকী, তামাং-শিবিরের অনেকেই যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এমন কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল।

২০০৭ সালে বিনয় তামাং, বিমল গুরুঙ্গ ও অনীত থাপার মিলিত প্রয়াসের নাম গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। ২০১৭তে, পাহাড়ের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন। পৃথক গোর্খাল্য়ান্ডের দাবিতে অশান্তি হয়ে ওঠে পাহাড়। তখন বিমল গুরুঙ্গ (Bimal Gurung), রোশন গিরিদের বিরুদ্ধে খুন, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, হিংসা ছড়ানো-সহ একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করে রাজ্য সরকার। গ্রেফতারি এড়াতে প্রায় সাড়ে তিন বছর আত্মগোপন বিমলের। তারপরেই চিড় ধরে সম্পর্কে। ‘শীতল বিচ্ছেদে’ জড়িয়ে পড়েন বিনয়-বিমল।

অনীত থাপার নীরব সমর্থন প্রাপক বিনয় তামাং একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জানিয়ে দেন তৃণমূলের পক্ষে লড়াই করলেও আলাদা করে প্রার্থী দেবে তাঁর দল। ওদিকে, সাড়ে তিন বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে পাহাড়ে ফেরেন গুরুঙ্গ। তৃণমূলের পক্ষেই লড়বেন গুরুঙ্গপন্থীরা এমনটাই স্পষ্ট জানিয়ে দেন পাহাড়ের ‘বেতাজ-বাদশা’। বিনয়-বিমলের এই শীতল লড়াইয়ের কথা স্মরণ করেই পাহাড়ে প্রার্থী দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস। উল্টে, ‘পাহাড়বন্ধুদের ভরসা করে’ তিনটি আসন ছেড়ে দেন মমতা।

কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে হালে পানি ফেরেনি। মোর্চার দুই তরফেই ইঙ্গিত,  ভোট ভাগাভাগিতে দার্জিলিং ও কার্শিয়াং-এ আসন খোয়ায় মোর্চা। যথারীতি তা না-পসন্দ শাসকদলের। মোর্চা শিবিরের সূত্রেই খবর, নির্বাচন আবহে যা কেবল ‘পরামর্শ’ ছিল, ভোটের পর তাই ‘চাপে’ রূপান্তরিত। রাজ্যের শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে কার্যত চাপ দেওয়া হচ্ছিল বলেই দাবি করেছেন মোর্চা শিবিরের কেউ কেউ। নির্বাচনের অনতিপরেই তাই দলত্যাগ করেন বিনয় তামাং। সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেন বিমলের হাতে। এরপরেই অনীত থাপার সঙ্গে কার্যত ‘দূরত্ব’-এর সূত্রপাত।  এ বার, তৃণমূল সুপ্রিমোর সভায় অনীত থাপার উপস্থিতি পাহাড়-রাজনীতিতে কোন নতুন মোড় নিয়ে আসে সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল।

আরও পড়ুন:  ‘মাদার ডেয়ারি নয়, মায়ের দুধ খেয়েছি’, চা-চক্রে দিলীপের নিশানায় ফের মমতাই