হুগলি: তিনি সাক্ষাৎ পাহাড় কন্যা। পাহাড়ই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বাড়িতে অসুস্থ বাবা। মন তাঁর পাহাড়েই। সেই স্বপ্নেই ভর করে একের পর এক শৃঙ্গ জয় বাংলার মেয়ে পিয়ালি বসাকের (Piyali Basak)। গত বছরই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন পিয়ালি। সম্প্রতি আরও এক আট হাজারি শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা (Mt. Annapurna) জয়ে তাঁর মুকুটে জুড়েছে আরেকটি পালক। পৃথিবীর দশম উচ্চতম শৃঙ্গ এটি। উচ্চতা ৮,০৯০ মিটার। তবে উচ্চতায় মাউন্ট এভারেস্টের থেকে খাটো হলেও অন্নপূর্ণা আরোহণ একেবারেই মুখের কথা নয়। জায়গায় জায়গায় ফাটল, ঝুলন্ত হিমবাহ যেন মারণ ফাঁদ তৈরি করে রাখে পর্বতারোহীদের জন্য। এক পা এদিক-ওদিক হলেই মৃত্যু অবধারিত। এই শৃঙ্গ অভিযানে বেরিয়ে আর ফিরে না আসার নজিরও খুব একটা কম নয়। এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সফল হয়ে ফিরেছেন চন্দননগরের বাসিন্দা পিয়ালি বসাক। নেপাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে টিভি৯ বাংলা ডিজিটাল। মন খুলে নিজের অভিজ্ঞতা, বাধা ও তা পেরিয়ে শৃঙ্গে চড়া, রেষারেষি, আক্ষেপের কথা বললেন বাংলার পাহাড় কন্যা।
পিয়ালির ‘দু’বার’ অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ জয়:
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই পিয়ালি জানান প্রায় দু’বার অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ সামিট করেছেন। তিনি জানান, “আমি অক্সিজেন ছাড়াই অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ জয় করতে পারতাম। প্রথমবার ১৪ মে সন্ধে ৭ টায় ক্যাম্প ৩ থেকে আমি ও আমার শেরপা দাওয়া শেরপা শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি।” ৬২০০ মিটার থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁরা। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ মে সকাল ৮ টায় ৮,০২০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন পিয়ালি। অর্থাৎ বাংলা নববর্ষেই একটা মাইলফলক তৈরি করতে পারতেন বাংলার পাহাড় কন্যা। ৮,০৯০ মিটার থেকে মাত্র ৭০ মিটার দূরেই ছিলেন তিনি। আর এবার অক্সিজেনও লাগেনি তাঁর। তবে পরিকল্পনার অভাবে এই যাত্রায় অন্নপূর্ণা অধরা থাকে পিয়ালির কাছে। তিনি বলেন, “সামনে আর দড়ি লাগানো ছিল না। তাই আর এগোতে পারিনি আমরা।” তাই স্বপ্ন চোখে নিয়ে বিধ্বস্ত শরীরেই ফিরতে হয়। পেটে জল, খাবার পড়েনি দু’দিন।
রেষারেষির অভিযোগ পিয়ালির :
প্রথমবারের ব্যর্থতার জন্য পিয়ালি রেষারেষির অভিযোগ তুলেছেন সহ-পর্বতারোহীদের বিরুদ্ধেও। তাঁর দলে ৮ থেকে ৯ জন পর্বতারোহী ছিল। অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে নিখোঁজ হওয়া হিমাচল প্রদেশের পর্বতারোহী বলজিৎ কউর তাঁর দলেই ছিলেন। ১৪ এপ্রিল যখন তিনি যাত্রা শুরু করতে চান, তখন বলজিৎ সহ বাকি পর্বতারোহীরা বারবার নিষেধ করেন। এর পিছনে রেষারেষির গন্ধ পান পিয়ালি। তিনি বলেন, “তাঁরা আপত্তি তোলায় ১৪ এপ্রিল বেরোতে সন্ধে ৭ টা বেজে যায়। ফিক্সড রোপ লাগানোর প্রথম শেরপা দল বিকেল ৫ টা তেই বেরিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গেই বেরোব ভেবেছিলাম। কিন্তু দলের বাকি আরোহীরা বাধ সাধায় তা হয়নি।” তাই পরের দিন সকালে ৮,০২০ মিটার উচ্চতায় দড়ি না পেয়ে ফিরে আসতে হয় তাঁদের। পিয়ালির আক্ষেপ, আরেকটু আগে বেরোলে হয়ত রোপ প্ল্য়ান্টিং টিমের দেখা পেতেন তিনি।
তাঁবুতে জায়গা না দেওয়ার অভিযোগ:
প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হয়ে ১৫ তারিখই ফিরে আসেন পিয়ালি। ততক্ষণে ক্যাম্প ৪ তৈরি হয়ে গিয়েছে। একটি তাঁবুও রয়েছে তখন। ভিতরে বলজিৎ কউর সহ অন্যান্য পর্বতারোহী ও শেরপারা ছিলেন। পিয়ালি বলেন, “আমাদের তাঁবুতে জায়গা দেওয়া হয়নি। আমি ও আমার শেরপা ওই ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ।” বাইরে তখন -৪০ ডিগ্রি থেকে -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাত পায়ে জমছে বরফ। বিকেল ৪ টে থেকে ৫ টা নাগাদ তাঁরা ক্যাম্প ৪ এ পৌঁছন। কিন্তু ওই ঠান্ডায় সন্ধে অবধি বাইরে ছিলেন তাঁরা। জ্বর চলে আসে পিয়ালির। ঠাণ্ডায় নাক ব্যথাও শুরু হয়। পরে কোনওমতে রাতটা তাঁবুতে কাটান।
অপ্রতিরোধ্য পিয়ালি:
এই পিয়ালিকে দমানো যায় না। জ্বর আসলেও ওই শরীরে ১৬ এপ্রিল ফের শুরু হল পিয়ালির শৃঙ্গ জয়ের অভিযান। বিকেল ৩ টেয় ক্যাম্প ৪ থেকে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। এদিকে সকাল ১১ টা নাগাদই বেরিয়ে গিয়েছেন বলজিৎ কউর সহ বাকি পর্বতারোহীরা। তবে দেরিতে বেরিয়েও বলজিৎকে পিছনে ফেলে দেন পিয়ালি। বলজিৎ-র আগেই সোমবার সকাল ৮ টা বেজে ৫০ মিনিটে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ জয় করেন পিয়ালি। অক্সিজেন ছাড়াই পুরো পথটা গেলেও শেষ পর্যন্ত শেরপার পরামর্শ মতো কৃত্রিম অক্সিজেন ব্যবহার করেন পিয়ালি। তিনি বলেন, “আগেরদিন ঠাণ্ডায় বাইরে থাকার জন্য নাকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। তাই শেরপার পরামর্শ মতোই ৮,০৭০ মিটার থেকে অক্সিজেন নিই। আর সেই অক্সিজেনেই আবার ক্যাম্প ৪ পর্যন্ত ফিরে আসি।”
চলতি পথে দেখা অনুরাগ ও বলজিতের সঙ্গে:
একদিকে যেখানে অন্নপূর্ণ শৃঙ্গ জয় করে ফিরেছেন বাংলার পিয়ালি। অন্যদিকে ব্যর্থ হয়ে অন্নপূর্ণায় নিখোঁজ হন আরও দুই ভারতীয় পর্বতারোহী। তাঁদের মধ্য়ে একজন পিয়ালিরই টিমের। বলজিৎ কউর। শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় দেখা হয় রাজস্থানের পর্বতোরোহী অনুরাগ মালুর সঙ্গে। তিনি বলেন, “যাওয়ার পথেই অনুরাগ মালুর সঙ্গে দেখা হয়। ও সামিট জয় না করেই ফিরছিল। আমি ওকে সাবধানে নামতে বলি। তারপর নিজের সামিটের উদ্দেশে এগিয়ে যাই। আমি কোনওভাবে ভেঙে পড়িনি। কারও অসফলতা আমাকে ছুঁতে পারেনি। কারণ এই ট্রেকিং অনেক দুর্গম ও কঠিন। নিজ নিজ দক্ষতার উপর এই সামিট জয় নির্ভর করে। আমি নিজের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। এর আগেও আমি অনেক সামিট করেছি তো। অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাছাড়া বাকিরা একবার অন্ন্পূর্ণা জয় করেছে। আমি তো দু’বার । একবার খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি।”
এদিকে সামিট থেকে ফেরার পথে দেখা হয় বলজিতের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ফেরার পথে দেখি দুই শেরপা নিয়ে বলজিৎ কউর সামিটের জন্য যাচ্ছে। তখনি বলজিতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি মঙ্গলবার বিকেল ৪ টেয়। আর রাত ২ টো নাগাদ খবর পাই বলজিৎ কউর আর নেমে আসেনি। দু’জন শেরপা ফিরে আসেন। আমরা সকলে মিলে গিয়েও ওকে নামিয়ে আনতে পারতাম না। পথ এতটাই দুর্গম। আমরা কোনওভাবে বেসক্যাম্পে এই খবর পাঠাই। আর অত উচ্চতায় কোনও পাইলট হেলিকপ্টারও চালাতে পারেন না। ভারতে খুব কম সেরকম পাইলট আছে। পরের দিন সকালে আলো ফুটতেই হেলিকপ্টার নিয়ে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। ওর সঙ্গে দু’জন শেরপা দেওয়া হয়েছিল। ওর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল আমেরিকার কিছু পর্বতারোহীদের জল খাবারও ওর সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। ”
অন্নপূর্ণা জয়ীর পরবর্তী অভিযান:
এরপর ২৭ এপ্রিল মাকালু শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন পিয়ালি। এখানেও খাড়াই পাথরের দেওয়াল থাকছে চ্য়ালেঞ্জ হিসেবে পিয়ালির জন্য। এক যাত্রাতেই অন্নপূর্ণা ও মাকালু জয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি। তবে বাড়িতে বাবা অসুস্থ থাকায় ফিরে আসতে হয়। ফের মাকালু জয়ে বেরোবেন তিনি।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও পর্বতারোহণ:
পিয়ালি বলেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে পাহাড়ে বেশি ধস নামছে, বরফ গলছে। ফলে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন পর্বতোরোহীরা। তাই যতটা সম্ভব গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানো যায় তার জন্য সতর্ক থাকার বার্তা দিয়েছেন বাংলার পাহাড় কন্যার।