
উলুবেড়িয়া: পাড়ার জলসার মাচায় চটুল গানের সঙ্গে নামছেন। তাও জামা খুলে কোমরে বেঁধে। স্বল্পবসনার গায়িকার পাশে ভল্ট দিচ্ছেন, দিচ্ছেন সামার সল্ট। মদ্যপ অবস্থায় স্বল্পবসনার দিকে কার্যত তাকিয়ে রয়েছেন হা করে। ক্রিসমাসের দিন পাড়ায় চটুল গানের সঙ্গে নাচলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হল সেই ভিডিয়ো। আর গ্রাম জুড়ে পড়ল ঢি ঢি। শ্যামপুর ১ নম্বর ব্লকের বিনোদচক তপসিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের এই কীর্তিকে শিক্ষক মহলেই পড়ে গিয়েছে শোরগোল। প্রশ্ন উঠছে, একজন সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক কীভাবে এধরনের আচরণ করতে পারেন? তাহলে সেই স্কুলের পড়ুয়াদেরই বা কী অবস্থা হতে পারে?
চন্দন দে। গত সাত বছর ধরে বিনোদচক তপসিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। ওই এলাকার বেশিরভাগ পরিবারই দিন আনা দিন খাওয়া। যেখানে পড়ুয়াদের বাবা-মায়ের নিত্য সংগ্রাম সংসারের চাল নুন কেনার গার্হস্থ্য অনুশাসনেই। তাঁদের কাছে সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পড়ানো বিলাসিতার সামিল। কিন্তু অক্ষর জ্ঞান দেওয়াতে ভরসা গ্রামের প্রাথমিক স্কুল। সেই স্কুলের শিক্ষক চন্দন দে, যিনি কিনা মদ্যপ অবস্থায় পাড়ার মাচার চটুল গানে খালি গায়ে নেচে বেড়ান।
প্রধান শিক্ষকের নাচের ভিডিয়ো ভাইরাল হতে তাঁর সম্পর্কে ছানবিন করা শুরু করে TV9 বাংলা। উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। চন্দন দে-র বাবাও স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাম আমলে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের স্কুলে চাকরি করতেন। কর্তব্যরত অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। বাবার চাকরি পেয়েছিলেন চন্দন দে। তিনিও প্রথমে ওই স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন। সাত বছর আগে বিনোদচক তপসিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। চাকরিজীবনে অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি প্রধান শিক্ষক হন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, স্কুলে প্রথম থেকে মদ খেয়ে আসতেন চন্দন দে। ওই স্কুলে আরও একজন শিক্ষিকা রয়েছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, বাচ্চারা বাড়ি ফিরে হেড স্যরের নামে বলতেন, যে তিনি মদ খেয়ে এসেছেন। এমনকি মদ্যপ অবস্থায় স্কুলে নাচ, অভব্য আচরণও করতেন বলে অভিযোগ। অভিভাবকরা জানাচ্ছেন, প্রধান শিক্ষকের আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন ওই শিক্ষিকা। কিন্তু তাঁর কথাতেও কর্ণপাত করা হয়নি বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।
এক অভিভাবক পরিতোষ পাত্র বলেন, “এই স্কুলে আগে অনেক পড়ুয়াই ছিল। একে একে অনেকেই চলে গিয়েছে। যেখানে প্রধান শিক্ষকই এমন কাজ করে বেড়ান, সেখানে বাচ্চা কীভাবে মানুষ হবে।”
এসবের মাঝে দু’বছর আগে হঠাৎই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেন চন্দন দে। স্কুলের পড়ুয়া গিয়ে ঠেকে ২৫ জনে। এরপর একদিন তাঁর মেয়ে রিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে আসেন। অভিভাবকদের দাবি, রিয়া তাঁর বাবার বদলে প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে থাকেন। কিন্তু সরকারি স্কুলে কীভাবে সেটা সম্ভব? এক অভিভাবক বলেন, “আমরা প্রশ্ন করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেন। শুনেছি ওঁ বিএড করেছেন। কিন্তু সরকারি স্কুলে কি এভাবে কারোর পরিবর্তে কেউ চাকরি করতে পারেন?”
প্রশ্নটা করা হয়েছিল রিয়ার কাছেও। তিনি রীতিমতো তেড়েফুঁড়ে ওঠেন সাংবাদিকের ওপর। স্কুলে বসেই ফোন করেন বেশ কয়েকজনকে। গ্রামে কয়েকজন ছেলে দলবল পাকিয়ে চলে আসেন স্কুলে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, আসলে চন্দন দে তৃণমূলের শিক্ষক সেলের নেতা ছিলেন। তাঁর মেয়ে যে বেনিয়মে কাজ করছেন, সেটা বোঝেন। অনীল মাহাতো বলে এক গ্রামবাসী বলেন, “আসলে মদ খাওয়ার পয়সাপত্র তো দেওয়া হয় ওদের হাতে রাখার জন্য।” আর রিয়া আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলছেন, “আপনি যান তো এখান থেকে। বাবা অসুস্থ বলে তাঁর কাজটা আমি করছি।” আর সাংবাদিকেই হুমকি দিয়ে বলছেন, “আপনারা দাঁড়ান এখানে, আমি লোক ডাকছি।”
বাবা প্রধান শিক্ষক, যিনি চটুল গানে নেচে বেড়াচ্ছেন. আর মেয়ে তাঁর জায়গায় বেআইনিভাবে চাকরি করছেন! হচ্ছেটা কী? বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলেন, “আগেরকার দিনে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁদের কাছে বিরাট অর্থও থাকত না।তাঁর ছাত্রদের পড়ানোই তাঁদের একমাত্র কর্ম ছিল। এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তা তো শিক্ষাব্যবস্থার দোষে নয়। তবে বুঝতে হবে এই শিক্ষকের কর্মবিচ্যুতি ঘটেছে। তাঁর কাজকর্ম শিক্ষকসুলভ নয়। তিনি যা করেছেন তা জঘন্য।”
কী বলছে পর্ষদ?
পর্ষদ সভাপতি গৌতম পাল বলেন, “ইতিমধ্যেই এই ঘটনা আমার নজরে এসেছে। স্কুলগুলোকে মূলত DPSC হাওড়া জেলা প্রাথমিক সংসদ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে আমি ওঁদের নির্দেশ দিয়েছি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।”