ব্যারাকপুর: শহর কলকাতা তো বটেই, রাজ্যজুড়ে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে গণপরিবহণের ক্ষেত্রে বড় সঙ্কটের আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। সেই পূর্বাভাসই কি সত্যি হল? কারণ পরিসংখ্যান বলছে, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অবলুপ্তির পথে কলকাতা সহ বিভিন্ন রুটের বেসরকারি বাস-মিনিবাস। যার জেরে আগামি দিনে গণপরিবহণ ব্যবস্থার হাল কী হবে সেই বিষয়টিই এখন ভাবাচ্ছে বাস মালিক থেকে নিত্যযাত্রীদের।
সূত্রের খবর, যাত্রী পরিবহনের প্রায় শতাধিক রুট রয়েছে ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের যাতায়াতের জন্য। কিন্তু সেই রুটগুলির মধ্যে কোনওটিই হয়ত উঠে গিয়েছে,আবার কোনওটি উঠতে বসেছে। তবে আগামী ২০২৪ সালে যে ৯৫ শতাংশ এই বাস রুট উঠে যাবে তা এক প্রকার নিশ্চিত বাস মালিক থেকে বাস কর্মীরা। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ২৫ লক্ষ মানুষ। এদের ভবিষ্যৎ কী হবে আগামী দিনে সেটাই এখন প্রশ্ন।
মুখ্যমন্ত্রী থেকে পরিবহন মন্ত্রী সবাইকে বারংবার জানানো সত্ত্বেও এখনও অবধি চুপচাপ সব মহলই দাবি বাস মালিকদের একাংশের। সাড়া রাজ্যের প্রায় ৮৫ শতাংশ যাত্রী নিয়ে পরিবহণ করে বেসরকারি বাস এবং মিনি বাস। শুধু কী তাই, বাসমালিকদের দাবি, মিনিবাসের তো অস্তিত্ব শেষের পথে। কারণ ২০১৮ থেকে এক ভাড়া নিয়ে চলছে। ২০২৩ অবধি ভাড়া না বাড়িয়ে বাস মালিকদের অবস্থা এখন ‘ভাঁড়ে মা ভবানি’। এরপরে আবার রয়েছে বে-আইনি অটো আর টোটোর দৌরাত্ম। যার ফলে সিংহভাগ লোকাল ভাড়া তাঁরাই ‘খেয়ে’ নিচ্ছে।
বাস-মিনিবাস মালিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক প্রদীপ নারায়ণ বসু জানান,“২০২৪-২৫ সালে কোনও বাসই থাকবে না। সমস্যায় পড়বেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। খুব শীঘ্রই যদি সরকার কোনও ব্যবস্থা না নেয় তাহলে লুপ্তপ্রায় হয়ে যাবে এই বেসরকারি পরিবহন শিল্প।”
ব্যারাকপুরের বিভিন্ন রুটের বাস মালিকরা জানাচ্ছেন, সরকার যদি ভাড়া না বাড়ায় তাহলে তারা এই যাত্রী পরিষেবা দিতে পারবেন না। টেনেটুনে আর কয়েক মাস টানতে পারলেও ২৪ সালে ১৫ বছরের গাড়ি বাতিলের তালিকায় তাঁরাও পড়ে যাবেন। তাই বাধ্য হয়েই গাড়ি কাটাই করে বিক্রি করে দিতে হবে। কারণ নতুন করে তাদের পক্ষে আর ২৮-৩০ লক্ষ টাকা খরচ করে গাড়ি কেনা সম্ভব নয়।
তবে ফাঁপরে পড়েছে বাস চালক,খালাসি,কণ্ডকটররা। একের পর এক রুট থেকে বাস কমে যাওয়ায় তাঁরা কাজ হারাচ্ছেন।আবার মালিকদের বাস থেকে আয় কমে যাওয়ায় তাদের মাসিক আয় ও কমে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, কলকাতা-সহ দেশের একাধিক হাইকোর্ট অনেক আগেই বেসরকারি বাণিজ্যিক গাড়ির আয়ু ১৫ বছর পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছিল। সূত্রের খবর, কলকাতার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কেএমডিএ এলাকায় এই বিধিনিষেধ চালু ছিল। আদালতে নতুন নির্দেশ অনুযায়ী শুধু কেএমডিএ এলাকা নয়, গোটা রাজ্যেই ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল হবে। আদালতের নির্দেশে পুরোনো বাস, মিনিবাস বাতিল করে ২০০৯ সালে ধাপে ধাপে নতুন বাস রাস্তায় নামানো হয়েছিল। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেই সব বাসের একটা বড় অংশের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। যার ফলে গণপরিবহণের ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি হবে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বাস মালিক সংগঠনের সদস্যরা। এই সবের মধ্যে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে এই বাস অবলুপ্তিতে কপালে ভাঁজ পড়েছে সকলের।
সেক্রেটারি সুজয় সাহা বলেন, “বর্তমানে বেসরাকারি বাসের অবস্থা কোমায় চলে যাওয়ার মতো। ডিজেলের দাম বাড়ছে। সাত-আটটাকা ভাড় নিয়ে বাস চালানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। এই রুটে ৮৪টি গাড়ি ছিল এখন ৩০টি গাড়ি চলে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ টা আবার কখনও চলে আবার কখনও চলে না।” অপরদিকে ফাঁপড়ে পড়েছেন নিত্যযাত্রীরাও। তাঁদের বক্তব্য, ধীরে-ধীরে বাস কমে যাওয়া দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ফলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে ভরসা টোটো-অটো।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় বেসরকারি রুটগুলির কত সংখ্যক বাস কমেছে…
রুট আগের সংখ্যা এখন অবস্থা
আগে ৮৫নং রুটে ৭০টি বাস ছিল। বর্তমানে ২০টি
আগে ৭৮ নং রুটে ৮৪টি বাস ছিল। বর্তমানে ৩০টি
এমএম ফাইভ (MM5) রুটে ২২ টি বাস ছিল। বর্তমানে ৩টি
কেএন রুটে ১২০ টি বাস ছিল। বর্তমানে একটিও নেই।
২১৪ নং রুটে ৫০ টি ছিল বাস। বর্তমানে চলে ২০ টি
৩৪/সি রুটে ২৭ টি বাস ছিল। বর্তমানে চলে ৫টি
৩০এ রুটে ১৭ টি বাস ছিল। বর্তমানে চলে ৪ টি
৩২ রুটে ৩৫ টি ছিল। এখন নেই
২৩৭ থেকে ৪০ টি বাস ছিল। বর্তমানে ১২টি
মিনিবাস: ১৯০, ১৮১, ১৫৯, ১৬৪ এবং ১৬০ রুটের সব মিনিবাস অবলুপ্ত
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ধাপে ধাপে পুরোনো বাস বাতিল করে মালিকরা নতুন গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছিলেন। আগামীতে তা সম্ভব নয় কেন? বাস মালিক সংগঠনের দাবি, পেট্রো পণ্য-সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের সব কিছুর দাম বাড়লেও দীর্ঘদিন বাস, মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। কোভিড কালে বাস মালিকদের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাস বসে গিয়েছে। ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে নতুন করে বাস কিনে রাস্তায় নামানোর সামর্থ নেই মালিকদের। যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কিছু প্রস্তাব নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিবহণ মন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন বাস মালিকরা। পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন,”ধীরে-ধীরে পরিবেশ বান্ধবগাড়ি রাজ্যে চালু হবে। আমরা বাস মালিকদের কথা মাথায় রেখে এখনই কড়া পদেক্ষেপ করছি না। বাস মালিকদের তরফে দেওয়া প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হবে।”