‘আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে’, সাত বছর পর বিচার পেলেন অ্যাসিড আক্রান্ত সঞ্চয়িতা

আগামিকাল একটা নতুন ভোর আসবে সঞ্চয়িতার (Sanchayita yadav) জীবনে। নতুন সূর্যের সবটুকু রশ্মি গায়ে মেখে এই জয়কে পাথেয় করে এগিয়ে যাবেন আরও বহুদূর।

'আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে', সাত বছর পর বিচার পেলেন অ্যাসিড আক্রান্ত সঞ্চয়িতা
সঞ্চয়িতা যাদব।
Follow Us:
| Updated on: Apr 12, 2021 | 9:48 PM

কলকাতা: যে বছর সঞ্চয়িতা যাদবের উপর অ্যাসিড হামলা (Acid Attack) হয়, তার দু’ মাস আগেই মুক্তি পেয়েছিল ‘চিরদিনই তুমি যে আমার ২’। এ ছবিতেও একজন অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়ের গল্প আছে। ২০১৪ সালে সঞ্চয়িতার উপর এই নৃশংস হামলার পর রাস্তায় বের হলে তাঁকে শুনতে হত, ‘ওই যে চিরদিনই তুমি যে আমার টু যাচ্ছে।’ প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতেন তিরিশের কোঠা পার না করা মেয়েটা। এখন সে সব গায়েও মাখেন না। ‘আমাকে তো লড়াইটা করতে হবে। লোকে কী বলল শুনলে চলে?’, গলায় একটা আলাদা আত্মবিশ্বাস দমদমের সঞ্চয়িতার। সোমবারই তাঁর অপরাধীকে সাজা শুনিয়েছে ব্যারাকপুর অতিরিক্ত জেলা এবং দায়রা আদালত। ১৪ বছরের জেল, ১ লক্ষ টাকা জরিমানা। সঞ্চয়িতার কথায়, “এই লড়াইগুলো জেতা খুব দরকার, যাতে অন্যরা আইনের উপর কখনও আস্থা না হারায়। অধিকাংশই তো দেখি ঘুরে বেড়ায়, সুখে সংসার করে। কিছুই হয় না।”

২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার আগের সন্ধ্যা। সে সময় সঞ্চয়িতার দমদমের বাড়িতে টিভি ছিল না। মা রান্নার কাজ করতেন। সেই বাড়িতেই টিভি দেখতে যাচ্ছিলেন। সম্পর্ক ভাঙার শোধ নেবে বলে পথ আটকায় সৌমেন সাহা। এলাকারই ছেলে। ‘বলল, আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না?’ প্রত্যুত্তর ‘না’ শুনেই মুখে ছুড়ে মারে অ্যাসিড। মুহূর্তে জ্বলে যায় সঞ্চয়িতার মুখ, শরীর, মন! ২০২১-এর সেপ্টেম্বর আসলে সাত বছর পূর্ণ হবে সেই ভয়ঙ্কর কালো সন্ধ্যার। ২০১৯ সালে মাকে হারিয়েছেন সঞ্চয়িতা। ‘আজ বারবার মায়ের কথা খুব পড়ছে। থাকলে খুব খুশি হত। আমার লড়াইকে প্রতি মুহূর্তে শক্তি জুগিয়েছে মা’, বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল। দীর্ঘশ্বাসে নিজেকে সামলে নিলেন সাহসিনী।

এখনও তাঁকে রাস্তায় নানা টিপ্পনি শুনতে হয়। তবে তিনি খুব একটা আমল দেন না। ‘আসলে অনেক মানুষ সমাজে বাস করে। সবাইকে নিয়েই তো চলতে হয়। খারাপ, ভাল’, অদ্ভূত তিতিক্ষা তাঁর গলায়। অ্যাসিডে মুখের ডান দিকটা পুরো গলে গিয়েছিল সঞ্চয়িতার। কপালের চামড়া নিয়ে বসানো হয়েছে নাকে। চোখে ৬টা সার্জারি। ‘ডান চোখটায় দেখতে পাই না, পাথর বসানো, পুরো ব্ল্যাঙ্ক’! তবু হার না মানার লড়াই চালানোর পণ তাঁর।

আরও পড়ুন: Corona Cases and Lockdown News: দেশে ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার, রেকর্ড সংক্রমণ দিল্লিতেও

স্বামীও খুব ‘সাপোর্টিভ’। হয়ত কাজের জন্য সবসময় সঙ্গে যেতে পারেনি, তবে আদালতের রায়টা শুনে সেও দারুণ খুশি। ‘ও আসলে একদম প্রথম থেকে পাশে ছিল। বন্ধু ছিল। এইসব ঘটনার পর আগলে রাখত। সম্পর্কটা এগোয়। পূর্ণতা পায় বিয়েতে’। সঞ্চয়িতা-শুভ্রর বিয়েতে টুইট করে উইশ করেছিলেন শাহরুখ খান। লড়াইয়ের প্রতিটা মুহূর্ত এখনও খুব টাটকা সঞ্চয়িতার মনে।

আমাদের দেশে অ্যাসিড হামলার ঘটনা আকছাড় ঘটে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জামিনে ছাড়া পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় অপরাধী। মামলা চলছে তো চলছেই। বারবার সঞ্চয়িতা বলছিলেন, আদালতের কাছে, আইন ব্যবস্থার কাছে তিনি খুবই কৃতজ্ঞ। তাঁকে সুবিচার পাইয়ে দিতে সবসময় পাশে থেকেছেন দুই আইনজীবী ইন্দ্রজিৎ দে, অঙ্কন বিশ্বাস। ছিলেন সরকার পক্ষের আইনজীবী সত্যব্রত দাসও। ইন্দ্রজিৎ জানালেন, “আমি বিচার ব্যবস্থাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এটা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক রায়। একজন আইনজীবী হিসাবে চেষ্টা করেছি যেন উনি তাড়াতাড়ি বিচার পান। উনি বিচার পেলেন, এটাই পাওনা।”

আগামিকাল একটা নতুন ভোর আসবে সঞ্চয়িতার জীবনে। নতুন সূর্যের সবটুকু রশ্মি গায়ে মেখে এই জয়কে পাথেয় করে এগিয়ে চলবেন আরও বহুদূর। অতীত তো থাকবেই! তাকে অস্বীকার করা যায় না ঠিকই। তবে তার জন্য ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে না থেকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচাতেই বিশ্বাসী সঞ্চয়িতা। চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের এই শক্তিই সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান এই বিজয়িনী।