
শিলিগুড়ি: কান ফাটানো আওয়াজ। তীব্র বিস্ফোরণ। মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দেহ। ছিটকে পড়ল হাত-পা-আঙুল। রাজধানীর বুকে সোমবার সন্ধ্যায় কী ফাটল, আরডিএক্স? তদন্তে উঠে আসছে অন্য তথ্য। ভারতের মতো দেশে যে দ্রব্য ঘরে ঘরে ব্যবহার হয়, যে কেউ দোকান থেকে সহজেই কিনতে পারেন, তা দিয়েই তৈরি হল বিস্ফোরক?
দিল্লি বিস্ফোরণে কোন বিস্ফোরক ব্যবহার করা হল, সেই রিপোর্ট এখনও আসেনি। ফরেনসিক পরীক্ষা হলেই সবটা স্পষ্ট হবে। তবে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, গাড়ি বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়েছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। মঙ্গলবার অর্থাৎ বিস্ফোরণের দিন সকালে ফরিদাবাদে যে অভিযান চালানো হয়, সেখানেও উদ্ধার হয় ২৯০০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এত এত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জড় করা হল! অথচ জানতেই পারল না কেউ?
একটু পিছিয়ে যাই। ৯০-এর দশক। মাওবাদীর ডায়েরি পড়ে চমকে উঠেছিল পুলিশ। রসায়নের হিসেব নিকেশ লেখা ছিল তাতে। সেই ফর্মুলা বলছে, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে ডিজেল মিশিয়ে তা সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় বিস্ফোরক। কত শতাংশে মেশাতে হবে, সেটাও নাকি লেখা ছিল ওই ডায়েরিতে। আর সেই বিস্ফোরক আরডিএক্সের মতোই শক্তিশালী। এখনও মাঝে মধ্যেই মাওবাদীদের ডেরা থেকে উদ্ধার হয় কেজি কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। গোয়েন্দারা বলছেন, বিভিন্ন মডিউলের নাশকতার ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে এই দুই সামগ্রী। আর এই রাসায়নিকই ঘুম কেড়েছে পুলিশের।
আসলে এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট যে কেউ কিনতে পারে। মানে আপনি বা আমি- যে কেউ। ব্যাগে করে কেজি কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কিনবেন, অথচ কেউ সন্দেহও করবে না। কারণ এটি আসলে সার। কৃষিজমিতে সার হিসেবে ব্যবহার হয়। ফলে খুবই সহজলভ্য। আর ডিজেল? সেটাও সহজলভ্য।
কী এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট?
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আসলে একটি নুনের মতো দ্রব্য। এতে কোনও গন্ধ নেই। রয়েছে অ্যামোনিয়া আর নাইট্রিক অ্যাসিডে তৈরি এই রাসায়নিক। দুটি জিনিসই জমির জন্য খুব ভাল। তাই এটি সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নুনের মতোই সহজে জলে মিশে যায় এটি।
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের আর একটি ভূমিকা হল, এটি অক্সিজেন জোগায় অর্থাৎ আগুন জ্বলতে সাহায্য করে। তাই এটি বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা খুবই স্বাভাবিক। দুরকমভাবে এটি বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। এক, এই রাসায়নিককে আগুনের মধ্যে ফেলে দিতে হবে অথবা দাহ্য পদার্থের মধ্যে মিশিয়ে আগুনের মধ্যে দিতে হবে। আর একটি উপায় হল, এই রাসায়নিককে বিস্ফোরক পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। যাকে কেমিস্ট্রির ভাষায় বলা হয়, ANFO বা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফুয়েল অয়েল। গোয়েন্দারা বলেন, খুব সহজে আর সস্তায় বোমা তৈরি করতে এই রাসায়নিকের জুড়ি নেই। শুধুই কি সার? খননকাজেও ব্যবহার করা হয় এটি। তাই এই রাসায়নিক সন্দেহের উর্ধ্বে।
প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “আরডিএক্স বানাতে অনেক খরচ পড়ে। এটা খুব সহজেই পাওয়া যায়। যে কেউ কিনতে পারবেন। কেউ সন্দেহ করে না।”
তবে কি আটকানোর কোনও উপায় নেই? যে যতখুশি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কিনতে পারে আর সংগ্রহ করে রাখতে পারে? না, কেন্দ্রীয় সরকারের স্পষ্ট গাইডলাইন আছে। সেখানে বলা আছে, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কেনা, বিক্রি করা, আমদানি বা রফতানি করা, তৈরি করা যায় না লাইসেন্স ছাড়া। যে কোনও জায়গায় এই রায়ানিক তৈরি করা যায় না। কোনও দাহ্য পদার্থের সঙ্গে এটি বহন করা যায় না। এমনকী আরও বলা আছে যে রাতের অন্ধকারে কেউ অ্যামোনিয়াম আনা-নেওয়াও করতে পারে না। কিন্তু কোথায় গাইডলাইন? কে মানে এসব? প্রশাসনেরও কি কোনও চিন্তা আছে? প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা আরও বলছেন, আসলে এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু গাইডলাইন আছে। সার দোকানে গিয়ে নজরদারি চালানো উচিত।
এই সার কেনাবেচার বিষয়টা সবটাই কৃষি বিপনন দফতরের দেখার কথা। বোঝাই যাচ্ছে, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ও ডিজেল-দুটি জিনিসই সঙ্গে নিয়ে চলাচলে কোনও বাধা নেই। রাস্তায় পুলিশ যদিও প্রশ্নও করে, তাহলেও তিনি জানাবেন সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনি নিয়ে যাচ্ছেন। আর ডিজেল তো গাড়ি থেকে বের করে নেওয়াই যায়।