Explained: CIA-র গোপন ‘অস্ত্র’ হিমালয়ের কোলে? গঙ্গায় মিশছে তেজস্ক্রিয় পদার্থ?
তুষারঝড়ের তীব্রতা দেখে ভীত ক্যাপ্টেন সেদিন অভিযানকারী দলকে রেডিওতে বলেন, 'ক্যাম্প ফোর? আমাদের কথা শোনা যাচ্ছে? আমরা অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প বলছি। দ্রুত ফিরে এস তোমরা। এক মিনিট সময়ও নষ্ট করবে না। যেটা নিয়ে গেছ, সেটাকে রেখেই ফিরে এস। এই অবস্থায় ওটাকে নিচে আনার চেষ্টা করবে না।' ক্যাপ্টেনের নির্দেশ পেয়ে অভিযাত্রী দল 'ক্যাম্প ফোর' নিউক্লিয়ার ডিভাইসটি ফেলে রেখেই নেমে আসতে থাকে। নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্লুটোনিয়াম ওই ডিভাইসে ছিল। তারপর থেকে আর কেউ কোনওদিন ওই যন্ত্রটিকে চোখে দেখেনি।

সালটা ১৯৬৫। ঠাণ্ডা-যুদ্ধ তখন চরমে। চিন সদ্যই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা সেরেছে। এই খবরের ঘুম ছুটে যায় তৎকালীন মার্কিন গোয়েন্দাদের। চিনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার উপর নজরদারি চালাতে CIA প্রায় ২৫ হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু নন্দা দেবীর চূড়ায় পারমাণবিক শক্তিতে চলা একটি নজরদারি অ্যান্টেনা বসাতে চায়। সেই লক্ষ্যে মার্কিন ও ভারতীয় পর্বতারোহীদের একটি বিশেষ দল অ্যান্টেনা, কেবিল ও ১৩ কিলোগ্রামের ওই জেনারেটরটি নিয়ে শৃঙ্গে উঠতে শুরু করে। কিন্তু শেষমুহূর্তে প্রবল তুষারঝড় গোটা পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়। ঝড় থেকে বাঁচতে তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়ামে ঠাসা জেনারেটর-টি ফেলে রেখেই কোনওমতে ফিরে আসেন আরোহীরা। আজও সম্ভবত বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলেই কোথাও পড়ে রয়েছে তেজস্ক্রিয় পদার্থে ঠাসা ওই ‘মারণাস্ত্র’।

সেদিন খানিকটা নিচ থেকে বেস ক্যাম্পে বসে ওই অভিযানের দিকে নজর রাখছিলেন ক্যাপ্টেন এম এস কোহলি। তুষারঝড়ের তীব্রতা দেখে ভীত ক্যাপ্টেন সেদিন অভিযানকারী দলকে রেডিওতে বলেন, ‘ক্যাম্প ফোর? আমাদের কথা শোনা যাচ্ছে? আমরা অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প বলছি। দ্রুত ফিরে এস তোমরা। এক মিনিট সময়ও নষ্ট করবে না। যেটা নিয়ে গেছ, সেটাকে রেখেই ফিরে এস। এই অবস্থায় ওটাকে নিচে আনার চেষ্টা করবে না।’ ক্যাপ্টেনের নির্দেশ পেয়ে অভিযাত্রী দল ‘ক্যাম্প ফোর’ নিউক্লিয়ার ডিভাইসটি ফেলে রেখেই নেমে আসতে থাকে। নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্লুটোনিয়াম ওই ডিভাইসে ছিল। তারপর থেকে আর কেউ কোনওদিন ওই যন্ত্রটিকে চোখে দেখেনি। ১৯৬৫-র অক্টোবরে CIA-র ওই মিশন ফেল হয়। ভারত ও আমেরিকা দুই দেশই আজ পর্যন্ত ওই গোপন অভিযানের সত্যতা সরকারিভাবে স্বীকার করেনি। কিন্তু সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে সেদিনের অভিযানের খবরটি ফাঁস হওয়ার পরেই শুরু হয়েছে জল্পনা। এখনও কি হিমালয়ের কোলেই ওই পারমাণবিক যন্ত্রটি রয়েছে? সেখান থেকে কি পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে? ২০২১-এ নন্দা দেবীতে হিমবাহ ধসে ২০০ জনের মৃত্যুর খবরে আবারও ওই পারমাণবিক জেনারেটরটি হিমালয়ের কোলে থেকে যাওয়ার জল্পনাকে উসকে দিয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে অনেকে NYT-র কাছে দাবি করেছেন, তেজস্ক্রিয় হওয়ায় ওই ডিভাইস ক্রমাগত তাপ ছড়াতে থাকে। ওই প্রবল তাপে বরফ গলেই বিপর্যয় ঘটেছে।
NYT সূত্রে খবর, এই মিশনের পরিকল্পনার সূত্রপাত এক একটি নৈশভোজের পার্টি থেকে। ওই পার্টিতে মার্কিন বায়ুসেনার তৎকালীন প্রধান জেনারেল কার্টিস লেমে কথা বলছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফটোগ্রাফার ও বিশিষ্ট পর্বতারোহী ব্যারি বিশপের সঙ্গে। কথায় কথায় বিশপ বলে ফেলেন, নন্দা দেবী শৃঙ্গ থেকে চিন ও তিব্বতের অনেকটা দেখা যায়। ব্যাস! মার্কিন বায়ুসেনা প্রধান তখনই পরিকল্পনা ফেঁদে বসেন, নন্দা দেবীর চূড়ায় একটি পারমাণবিক শক্তিতে চলা নজরদারি যন্ত্র বা ডিভাইস পাঠাবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ! বিশপের নেতৃত্বে CIA গোপন অপারেশন শুরু করে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের আড়ালে পুরোদস্তুর অপারেশনের জন্য ‘সিকিম সায়েন্টিফিক এক্সপিডিশন’ তৈরি হয়। অভিযানের জন্য মার্কিন পর্বতারোহী জিম ম্যাকার্থিকে মাসিক ১০০০ ডলারের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়। ১৯৬২-র যুদ্ধের পর থেকে চিনকে আর বিশ্বাস করতে না চাওয়া ভারতও নিঃশব্দে অভিযানে যোগ দেয়। তবে পুরোটাই গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। ক্যাপ্টেন এম এস কোহলি ভারতের তরফে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তবে এই পরিকল্পনা একেবারেই বোকামো, সেদিনও বলেছিলেন ক্যাপ্টেন কোহলি। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এরকম পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস বসানোর বুদ্ধি যেই CIA-কে দিয়ে থাকুক সেটা চূড়ান্ত অবাস্তব, বলেছিলেন কোহলি।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! শুরু হয় কঠিন ও প্রায় অসম্ভব CIA-র কোভার্ট অপারেশন।

১৯৬৫-র ১৬ অক্টবর যখন আচমকাই তুষারঝড় আসে, সেদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিল অভিযাত্রী দলটি। দলটির সদস্য সোনাম ওয়াংইয়াল নামে এক ভারতীয় পর্বতারোহী NYT-কে জানিয়েছেন, ‘খালি পেটে, এক ফোঁটা জল, এক দানা খাবার ছাড়া আমাদের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ছিল না।’ কোহলি ওই অবস্থায় দলটিকে রেডিওতে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে নেমে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু ম্যাকার্থি ওই নির্দেশ শুনে রাগে ফেটে পড়েন। তিনি কোহলির উপর চিৎকার করে বলেন, ‘জেনারেটর নামিয়ে আনতেই হবে। তুমি খুব বড় ভুল করছো।’ কিন্তু অভিযাত্রী দলটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সব যন্ত্রপাতি পাহাড়ে ফেলে রেখেই, তাঁদের নেমে আসার নির্দেশে অনড় থাকেন ক্যাপ্টেন কোহলি। সেইমতো দলটি বেস ক্যাম্পে ফিরেও আসে। পরের বছর পারমাণবিক জেনারেটরটি উদ্ধার করতে ফের অভিযান চালায় CIA। কিন্তু দেখা যায়, তুষারঝড় যেন ওই যন্ত্রপাতি গিলে খেয়েছে। একটা টুকরোই আর অবশিষ্ট নেই। কোহলি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, এই খবর শুনে CIA কর্তারা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠেন। ‘ওগুলো প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল’ বলেন এক CIA কর্তা। একবার নয়, ওই পারমাণবিক যন্ত্র খুঁজতে একাধিক অভিযান চালায় CIA। জেনারেটরটি প্রবল তাপ উৎপন্ন করায় ক্রমশই বরফ গলে আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছিল। তল্লাশি অভিযান, রেডিয়েশন ডিটেক্টর, ইনফ্রারেড সেন্সর নিয়ে গিয়েও খোঁজ চলে। কিন্তু অ্যান্টেনা, জেনারেটর, এমনকী অভিযানে ব্যবহৃত মই বা দড়ির অবশিষ্টাংশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিশনকে ‘ফেল’ বলে দাগিয়ে দেয় CIA। ১৯৭৮ পর্যন্ত এই মিশন সংক্রান্ত কোনও তথ্যই কারও জানা ছিল না। ১৯৭৮-এ এক নবীন সাংবাদিক হাওয়ার্ড কোহন এই খবর প্রথমবার তাঁর ম্যাগাজিনে ছাপেন ও মিশনের খুঁটিনাটি ফাঁস করে দেন। এই খবরে ভারতে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। ‘CIA ভারতের জলে বিষ মেশাচ্ছে’– লেখা পোস্টার হাতে বিক্ষোভ দেখান প্রতিবাদীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত আসরে নামেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। দেশাই যেভাবে এই আন্দোলনকে সামলেছিলেন, তার প্রশংসা করে কার্টার একটি গোপন চিঠিও লেখেন পরে। কিন্তু প্রকাশ্যে দুই রাষ্ট্রপ্রধান একটাও শব্দ খরচ করেননি।

এখন ওই অভিযাত্রী দলের বহু সদস্যই হয় বৃদ্ধ হয়েছেন নয়তো মারা গেছেন। জিম ম্যাকার্থি, যাঁর বয়স এখন ৯০, আজও ওই ঘটনার কথা ভাবলে রেগে যান। তাঁর বক্তব্য, যে হিমবাহের জল গঙ্গায় এসে মেশে, তাতে যদি প্লুটোনিয়াম মিশে যায় কী কাণ্ডটা হবে ভাবতে পারেন? জানেন, কত মানুষ আজ গঙ্গার জল পান করে বেঁচে আছেন? ক্যাপ্টেন কোহলি আজ মারা গেছেন। কিন্তু তাঁরও শেষ কথা ছিল, ‘আমি কখনই এই মিশনে সম্মতি জানাইনি। CIA আমাদের সে সময় আসল উদ্দেশ্য বলেনি। ওদের পরিকল্পনা ছিল না, কাজের পদ্ধতিতেও গলদ ছিল। যে এটা করতে বলেছিল সেও একটা গাধা। আমরা ওদের বোকামির ফাঁদে পড়ে গেছিলাম। ওই অভিযান আমাদের জীবনের একটা কালো অধ্যায়।’ আশঙ্কা আরও রয়েছে। ওই পারমাণবিক যন্ত্র আজও হিমালয়ের কোলে যদি থাকে, তাহলে অসাধু ব্যক্তিদের হাতে পড়লে সেটি ব্যবহার করে পরমাণু বোমা বানানো যায়। সেক্ষেত্রে গোটা বিশ্বই বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
