
নয়াদিল্লি: যুধিষ্ঠিরে নয়। দুনিয়া চলছে চার্বাকে। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময়ে জঙ্গলের মধ্যে স্বয়ং ধর্ম, যক্ষ সেজে নিজের পুত্র ধর্মরাজের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরকে দেওয়া তাঁর প্রশ্নমালার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল সুখী কে। পাণ্ডব উত্তর দিয়েছিলেন, যিনি প্রবাসে থাকেন না। যাঁর কোনও ঋণ নেই। যিনি দিনের শেষে ঘরে ফিরে নিশ্চিন্তে শাকান্ন ভক্ষণ করেন, তিনিই সুখী। একদিকে পুরাণে এই কথা। অন্যদিকে এই ভারতীয় দর্শনেই ঋষি চার্বাক বলে গিয়েছেন ধার করেও ঘি খেতে ভুলো না। কারণ, সুখে থাকাটাই আসল কথা।
প্রতি পদে পদে ঋষিবাক্য মেনে চলেছি একাংশের ভারতীয়। ঋণ নিয়ে শখ-আহ্লাদ মেটাচ্ছে তাঁরা। স্বেচ্ছায় গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে ইএমআই-এর হাঁড়িকাঠে। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ, আমেরিকারও হয়েছে এমন দশা। মার্কিন সরকারের ধারের পরিমাণ এখন দেশের জিডিপি-র ১২৫ শতাংশ। মানে ১০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়লে বাজারে ধার ১২৫ টাকা। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এ নিয়েই আমেরিকাকে সতর্ক করেছে। বলেছে যে এভাবে চললে, ২০৩০ সালের মধ্যে তাঁদের দশা ইতালি আর গ্রিসের চেয়েও খারাপ হবে।
২০০৯ সালে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার পর ইউরোপের একাধিক দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল পর্তুগাল, ইতালি, গ্রিস ও স্পেনের। এই ৪ দেশের একযোগে নাম হয়ে যায় পিগস কান্ট্রি। আইএমএফ বলছে, পিগসের মধ্যে এখন ইতালির ডেট-জিডিপি রেশিও ১৩৭ শতাংশ। গ্রিসে সরকারি ধারের অঙ্ক ও দেশের জিডিপি-র ১৩০ শতাংশ। মার্কিন অর্থনীতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ২০৩০ সালে আমেরিকার ডেট-জিডিপি রেশিও বেড়ে দাঁড়াবে ১৪৩ শতাংশ। ধার করায়, ইউরোপের দুই রুগ্ন অর্থনীতিকেও টেক্কা দেবে দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ। একাংশের বিশেষজ্ঞরা বলেন, তেলা মাথায় হাত বোলানো, স্বভাব সবার। তাই, যার টাকা আছে, সে আরও ধার পায়। আর যার সত্যিই অভাব, সে নিজেকে ক্রেডিয়ওয়র্দি প্রমাণ করতে না পারায়, চটি ছিঁড়ে গেলেও ব্যাঙ্ক লোন পায় না।
আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ। ইউএস ট্রেজারি বন্ডকে সারা বিশ্ব সবচেয়ে সুরক্ষিত লগ্নির জায়গা বলে মনে করে। ফলে, আয়ের চেয়ে ধার বেশি হয়ে গেলেও মার্কিন সরকারের কখনও খোলা বাজার থেকে টাকা তুলতে অসুবিধা হয় না। ভারতের ডেট-জিডিপি রেশিও একশো টাকায় সাড়ে বিরাশি টাকা। আমেরিকার ধারের পরিমাণ টাকার অঙ্কে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হলেও ভারত সরকারের বন্ডের চেয়ে মার্কিন সরকারের বন্ডের রেটিং বেশি। আর, চাইলেই যখন ধার পাওয়া যাচ্ছে, তখন নেবো না কেন। এই যুক্তিতে আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে ধার নেওয়া বাড়িয়েই যাচ্ছে।
তবে, ট্রাম্পের আমলে একটা গণ্ডগোল হয়েছে। যেটা নিয়ে আইএমএফ চিন্তায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্রেন চাইল্ড, বিগ বিউটিফুল বিল নিয়ে আমেরিকায় এখনও বিতর্ক চলছে। যে বিলের মূল কথাই হল, ধনীদের কর ছাড়। ফলে, কোষাগারে আমদানি কমছে। এদিকে, ট্রাম্প আবার ডিফেন্সের পিছনে খরচ বাড়িয়েই চলেছেন। ফলে, ভাঁড়ারে টান পড়ছে। সরকার আরও বেশি করে বন্ড ইস্যু করার দিকে ঝুঁকছে। যা নিয়ে ইউএস ফেডারাল রিজার্ভের সঙ্গে এই মুহূর্তে ওভাল অফিসের ঠাণ্ডা লড়াইও শুরু হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার তাই আমেরিকাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ধার এইভাবে বেড়ে চললে একদিন কিন্তু আচমকা সব কিছু ধসে যেতে পারে। আর মার্কিন অর্থনীতিতে কোনও বিপদ এলে তার চেন রিঅ্যাকশনে সারা দুনিয়াই প্রভাবিত হবে। ফলে, চিন্তার জায়গা একটা থাকেই।