
গত কয়েক মাসে ডলারের তুলনায় অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে টাকার দাম। ১ ডলারের দাম পেরিয়েছে ৯০ টাকার গণ্ডিও। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি যেখানে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে সেখানে টাকার দামে এই পতন দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের মনে একটা অদ্ভূত উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। কিন্তু কী কারণে এমন হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহ্যিক কিছু চাপ ও অভ্যন্তরীণ কিছু দুর্বলতার কারণেই এই সংকট তৈরি হচ্ছে।
ভারত একটি আমদানি-নির্ভর দেশ। অপরিশোধিত তেল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, যন্ত্রাংশ ও সোনার মতো পণ্য কেনার জন্য বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ করে আমাদের দেশ। আর যখনই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ে, তখনই ভারতের ডলার খরচ বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর এই তেল বা ইলেকট্রনিক্স পণ্যের পেমেন্ট করতে বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয় ভারতকে। যা সরাসরি ভারতীয় টাকার মূল্য কমিয়ে দেয়। সুতরাং, টাকার মূল্য গোটা পৃথিবীর বাজারের ওঠানামার উপর অনেকটা নির্ভরশীল।
টাকার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ বাণিজ্য ঘাটতি বা ট্রেড ডেফিসিট। যখন ভারতের আমদানির পরিমাণ রফতানির চেয়ে বেশি হয়, তখন দেশ থেকে ডলার বেশি খরচ হয়। কিন্তু ডলার উপার্জন কম হয়। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে ভারতীয় মুদ্রার উপর চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলে। সফটওয়্যার বা পরিষেবা রফতানি বাড়লেও, পণ্য রফতানি সেই অনুপাতে বাড়েনি। আর সেই কারণেই এই বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আর এই ঘাটতি একটি দুর্বল করছে টাকাকে। তার ফলে, কমে যাচ্ছে টাকার মূল্য।
ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টর বা প্রাতিষ্ঠানিক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের শেয়ার বাজার ও বন্ড বাজারে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা; যেমন ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, মন্দার ভয় বা আমেরিকায় সুদের হার বৃদ্ধি, দেখা দিলেই এই বিনিয়োগকারীরা দ্রুত টাকা তুলে নিতে শুরু করেন। তারা ভারতীয় টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে টাকা বের করে নিলে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। আর ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়া মানে টাকার পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের দামও বেড়ে যাওয়া। কারণ সাধারণ অর্থনীতির নিয়মে চাহিদা বাড়লে দামও বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদ সুপর্ণ পাঠক বলছেন, “টাকার দাম পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছেন। তারা মনে করছে যে তাদের বিনিয়োগ ধরে রাখলে ক্ষতি হবে তাদের। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাকার দাম কমছে।”
সম্প্রতি, একাধিক বার রেট কাট করেছে ফেডারেল রিজার্ভ। আর রেট কাট করলে কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়। ফলে, বিভিন্ন সংস্থা আমেরিকায় বাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ায়। বৃদ্ধি পায় ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার। নাগরিকদের হাতে নগদের পরিমাণ বাড়ে। ফলে, খরচ করে তারা। বাজারে লেনদেন হয়। বাড়তে থাকে বিভিন্ন সংস্থার রেভেনিউ ও প্রফিট। এ ছাড়াও ফিক্সড ডিপোজিট ও বন্ডের রিটার্ন কমে গেলে, বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারের দিকে ঝোঁকে। ফলে শেয়ার বাজারে একটা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। আর সেই কারণেই বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা আমেরিকার মার্কেটে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে, শক্তিশালী হয় ডলার। দাম কমে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার।
টাকার মূল্য কমলে দেশের রফতানিকারকদের সুবিধা হয়। কারণ তারা ডলারের বিনিময়ে বেশি ভারতীয় টাকা পায়। প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠালেও লাভবান হন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য এর ফল হয় বিপরীত। আমদানি করা পণ্যের, যেমন জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, খাদ্য ও পরিবহণের খরচে। এছাড়া, বিদেশে পড়াশোনা, বিদেশ ভ্রমণ ও আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধের খরচও বাড়ে।
অর্থনীতিবিদ সুপর্ণ পাঠকের সঙ্গে এই বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। তিনি বলছেন, দেশের নীতি নির্ধারকদেরও ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে। “ভারতে নীতিনির্ধারকদেরও ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে। এবার আগে এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করত। প্রয়োজনে ডলার কিনতো বা বিক্রি করত। এটাকে বলা হয় স্টেবিলাইজেশন গেম অর্থাৎ বাজারে একটা সাম্যতা নিয়ে আসার জন্য একটা হস্তক্ষেপ। আর সেটাই এখনও করছে না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।”
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ডলার বিক্রি করে বা ডলার কিনে বাজারে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করলেও দীর্ঘমেয়াদের জন্য রফতানি বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখা আবশ্যক। আর যতক্ষণ না এই কাজগুলো হচ্ছে ততক্ষণ টাকার বাজারে একটা চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকবে।