মিউচুয়াল ফান্ড কী?
মিউচুয়াল ফান্ড (Mutual Fund) হল একপ্রকার তহবিল যা একজন পেশাদার ফান্ড ম্যানেজার দ্বারা পরিচালিত হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে, সেই অর্থ ইক্যুইটি, বন্ড, বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে। মিউচুয়াল ফান্ড শব্দটি সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ভারতে ব্যবহৃত হয়। যদিও মিউচুয়াল ফান্ডের পরিবর্তে ইউরোপে SICAV (Société d’Investissement à Capital Variable বা Investment Company with Variable Capital) এবং ব্রিটেনে Open-Ended Investment Company নামেই পরিচিত।
কী কী ধরণের মিউচুয়াল ফান্ড হয়?
মিউচুয়াল ফান্ড বেশ কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন, ইক্যুইটি ফান্ড, ডেট ফান্ড, গোল্ড ফান্ড ইত্যাদি। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের (Market Capitalization) বা কোম্পানিগুলোর মূলধনের উপর ভিত্তি করে যে ফান্ডগুলো হয় তাদের ইক্যুইটি ফান্ড বলে। ইক্যুইটি ফান্ড (Equity Funds) সাধারণত ৩ ধরণের ফান্ড হয়। প্রথম, লার্জ ক্যাপ ফান্ড (Large Cap Funds)। দ্বিতীয়, মিড ক্যাপ ফান্ড (Mid Cap Funds)। তৃতীয়, স্মল ক্যাপ ফান্ড (Small Cap Funds)।
১। লার্জ ক্যাপ কী?
যে সমস্ত কোম্পানি নিজস্ব সেক্টরে পায়োনিয়র বা মার্কেট লিডার অর্থাৎ, বড় বড় যে সমস্ত কোম্পানি যাদের অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট ভাল, ক্যাশ ফ্লো স্টেডি ও ব্যালেন্স শিট যথেষ্ট শক্তিশালী সেই সব কোম্পানিকে লার্জ ক্যাপ কোম্পানি বলে। লার্জ ক্যাপ কোম্পানির বাজারে মূলধন ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়। বিনিয়োগের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী ভারত সরকারের সংস্থা সেবির (SEBI) নিয়ম অনুযায়ী যদি ইক্যুইটি ফান্ডের মূলধনের ৮০ শতাংশ লার্জ ক্যাপ কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা থাকে, তাহলে সেই ইক্যুইটি ফান্ডগুলোকে লার্জ ক্যাপ ফান্ড বলে। লার্জ ক্যাপ কোম্পানিগুলো স্টেবেল বা স্থিতিশীল হওয়ায় লার্জ ক্যাপ ফান্ডে বিনিয়োগ করা অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আর ঝুঁকি কম হওয়ায় বাকি দুই প্রকার ফান্ডের তুলনায় এতে রিটার্নের পরিমানও কম হয়।
২। মিড ক্যাপ কী?
লার্জ ক্যাপ কোম্পানিগুলোর তুলনায় বাজারে খানিকটা ছোট কোম্পানিগুলোই সাধারণত মিড ক্যাপ কোম্পানি। সেবির নিয়ম অনুযায়ী মূলধনের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হলে তাকে মিড ক্যাপ কোম্পানি বলে। আর মিড ক্যাপ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে যে ফান্ডগুলো সেইগুলোই মিড ক্যাপ ফান্ড। মিড ক্যাপ ফান্ডে বিনিয়োগ মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ, আর এতে রিটার্নের পরিমাণ লার্জ ক্যাপ ফান্ডের তুলনায় খানিকটা বেশিই।
২। স্মল ক্যাপ কী?
যে সমস্ত কোম্পানির মূলধন ৫০০০ কোটি টাকার কম সেই সব কোম্পানিকে স্মল ক্যাপ কোম্পানি বলে। স্মল ক্যাপ কোম্পানিতে সাধারণ ভাবে বিনিয়োগের ঝুঁকি বেশি হয়। যদিও রিটার্ন অনেক বেশি পাওয়া যায়। সেবির নিয়ম অনুযায়ী স্মল ক্যাপ ফান্ডগুলো তাদের বিনিয়োগের ৬৫ শতাংশ স্মল ক্যাপ কোম্পানিতে করে। যদিও রিপোর্ট বলে খুব কম স্মল ক্যাপ কোম্পানিই বাজারে টিকে থাকতে পারে।
ডেট ফান্ড
ডেট ফান্ড হচ্ছে এমন এক ধরণের ফান্ড জে ফান্ডে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম ঝুঁকির। যদিও ডেট ফান্ডে বিনিয়োগে রিটার্নের পরিমাণ বাৎসরিক ৭ থেকে ৮ শতাংশ হয়ে থাকে, অনেকটা ফিক্সড ডিপজিটের মতোই। যদিও ফিক্সড ডিপজিটের তুলনায় ডেট ফান্ডের সুবিধা আছে বেশ কিছু। এই ক্ষেত্রে আপনি প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে নিলে কোনও পেনাল্টি দিতে হবে না ফিক্সড ডিপোজেটের মতো। ডেট ফান্ড সাধারণত সরকারি বন্ড, কর্পোরেট বন্ডে অর্থ বিনিয়োগ করে।
গোল্ড ফান্ড
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই ফান্ডের এমন নাম কেন। গোল্ড ফান্ডে টাকার বেশিরভাগটাই সোনায় বিনিয়োগ করা হয়। আর কিছুটা টাকা কোম্পানিগুলো ক্যাশ ইনফ্লোর জন্য রেখে দেওয়া হয়।
কোন ধরণের ফান্ডে কেমন রিটার্ন পাওয়া যায়?
বিভিন্ন ফান্ডে বিভিন্ন রকম ঝুঁকির সঙ্গে বিভিন্ন রকম রিটার্ন পাওয়া যায়। লার্জ ক্যাপ মিউচুয়াল ফান্ডে সাধারণত বছরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ রিটার্ন আশা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে কমপক্ষে ৭ বছর বিনিয়োগ করে যেতে হবে।
ইকোনমিক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী মিড ক্যাপ মিউচুয়াল ফান্ডগুলো গত ৫ বছরে প্রায় ১৬.৬২ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, অতীতে পাওয়া রিটার্ন ভবিষ্যতে নাও পাওয়া যেতে পারে।
ইকোনমিক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ৫ বছরে স্মল ক্যাপ মিউচুয়াল ফান্ড প্রায় ১৮.৬৭ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে। ডেট ফান্ডে রিটার্নের পরিমান যদিও খুব বেশি নয়, বাৎসরিক ৭ থেকে ৮ শতাংশ।
গোল্ড ফান্ডের গ্রাফ সোনার দামের সঙ্গে ওঠা নামা করলেও কিছু সমস্যা থেকেই যায়। যেমন? যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ড তাই ফান্ডের এক্সপেন্স রেসিও, এক্সিট লোড, স্ট্যাম্প ডিউটি সহ একাধিক ট্যাক্স বাবদ বেশ কিছুটা লাভের অঙ্ক কাটা পড়ে। এছাড়াও মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিগুলো কিছুটা টাকা ক্যাশ হিসাবে রেখেও দেয়। ফলে সোনাতে যতটা রিটার্ন পাওয়া যায় তার তুলনায় গোল্ড ফান্ডে ২-৩ শতাংশের মতো কম রিটার্ন পাওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রে সোভারেইন গোল্ড বন্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। কীভাবে? পড়ে দেখুন।
কীভাবে বিনিয়োগ করা সব থেকে লাভজনক?
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ দুভাবে করা যেতে পারে। প্রথম, লামসাম বিনিয়োগ, বা একসঙ্গে অনেক টাকা বিনিয়োগ করা। আর দ্বিতীয়, সিপ (SIP) বা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে বিনিয়োগ। লামসাম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগের সময় মার্কেট ওভার ভ্যালু হয়ে থাকলে পরবর্তীতে শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন কমে যায়। আবার লামসাম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সময় মার্কেট আন্ডার ভ্যালু হয়ে থাকলে বিনিয়োগের রিটার্ন অনেক বেশি হয়। আর সিপ করলে সেক্ষেত্রে মার্কেটের কী অবস্থা তার উপর নির্ভর না করেই বিনিয়োগ করা যায়। যেহেতু সিপের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিমাসে বিনিয়োগ করা হয়, তাই বাজারের ওঠাপড়ার ঝাপটা খুব একটা সিপের রিটার্নের হেরফের ঘটায় না।
বাজার ওভার ভ্যালুড নাকি আন্ডার ভ্যালুড
সাধারণভাবে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন জিডিপির প্রায় সমানই থাকে। কিন্তু এদের অনুপাত যদি ০.৭-এর কম হয় তাহলে বোঝা যায় মার্কেট আন্ডার ভ্যালুড। আর এই অনুপাত ১.২৫-এর বেশি হলে বোঝা যায় মার্কেট ওভার ভ্যালুড।
ওয়ারেন বাফেটের পরামর্শ
শেয়ার মার্কেটের মহাতারকা বলা যায় যাঁকে, সেই ওয়ারেন বাফেট বলেছিলেন, যে কোনও ফান্ডের তুলনায় ইন্ডেক্স ফান্ড সব সময় ভাল। এবং বিশেষজ্ঞরাও দেখেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্ডেক্স ফান্ড অন্য ফান্ডের তুলনায় বেশি ভাল রিটার্ন দেয়। তবে এখানে বলা বিনিয়োগ সম্পর্কিত তথ্য কোনও উপদেশ নয়। বা এর উপর ভিত্তি করেই আপনাকে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে এমনটাও নয়। তবে এই তথ্য আপনাকে বিভিন্ন বিনিয়োগের ধারণা দেবে।
*যে কোনও ধরনের বিনিয়োগের ঝুঁকি রয়েছে। ফলে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত নথি অবশ্যই ভালভাবে পড়ে নেবেন।