বিরাট বড় ব্যাঙ্ক ফেল করল, সারা দেশ তোলপাড়! আঙুল উঠেছে কলকাতার ঠাকুর বাড়ির বিরুদ্ধে

Prince Dwarkanath Tagore: মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই ফেল করে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কটির এমন করুণ পরিণতির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকটি কারণ দর্শিয়েছেন।

বিরাট বড় ব্যাঙ্ক ফেল করল, সারা দেশ তোলপাড়! আঙুল উঠেছে কলকাতার ঠাকুর বাড়ির বিরুদ্ধে
Image Credit source: Getty Images

Jul 05, 2025 | 3:28 PM

ব্যাঙ্ক ফেল! এই শব্দ দুটি পরপর শুনলেই বুক উড়ে যায় সাধারণ মানুষের। হ্যাঁ, এ কথা আজও যতটা সত্য, প্রায় ২০০ বছর আগেও ততটাই সত্য ছিল। আর এই ব্যাঙ্ক ফলের পিছনে যদি বিশ্বখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা থেকে থাকে? হ্যাঁ, পরাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতায় এক দুঃখজনক ব্যাঙ্ক বিপর্যয়ের কাহিনীর পিছনে ছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভূমিকা, এমনটাই বলে থাকেন ইতিহাসবিদরা।

ব্রিটিশ ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হলে বাঙালিদের কাছে সবার আগে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের পিতামহের নাম। কারণ, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন সে যুগের কলকাতার অন্যতম নামী ব্যক্তি, বিরাট ব্যবসায়ী ও প্রথম ভারতীয় যিনি কোনও ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর পদেও বসেছিলেন। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অনেকেরই বন্ধু স্থানীয় ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। শোনা যায়, ইংল্যান্ডে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব কালে প্রিন্স দ্বারকানাথ হয়ে উঠেছিলেন খোদ মহারানি ভিক্টোরিয়ার বেশ কাছের মানুষ। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি কতটা বিত্তবান ও প্রভাবশালী ছিলেন সে যুগে। আর সেখান থেকেই ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।

১৮২৮ সালে দ্বারকানাথ ও তাঁর জাহাজ ব্যবসায়ী (পার্সি) বন্ধু রুস্তমজি কওয়াওসজি মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। তবে ভুলেও ভাববেন না যে এই ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে আজকের ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কোনও সম্পর্ক রয়েছে। দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্থা। আসলে ব্রিটিশ সংস্থা ম্যাকিন্টস অ্যান্ড কোম্পানির ‘কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক’ ও পালমার অ্যান্ড কোম্পানির ‘দ্য ক্যালকাটা ব্যাঙ্ক’-এর সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল দ্বারকানাথদের ব্যাঙ্ক। আর এই ব্যাঙ্কেরই ডিরেক্টর পদে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা। তবে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত, এমন একেবারেই বলা যায় না। আর এই নিয়ন্ত্রণের জন্যই পরবর্তীতে সময় সাক্ষী থেকেছিল এক ঐতিহাসিক উদ্যোগের বিফল হওয়ার করুণ কাহিনির।

১৮২৮ সালে যাত্রা শুরু করে মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই (১৮৪৮) ফেল করে এই ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কটির এমন করুণ পরিণতির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকটি কারণ দর্শিয়েছেন। জানা যায়, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক যখন শুরু হয়েছিল,তখন সংস্থাটির মূলধন (ক্যাপিটাল) ছিল ১২ লক্ষ টাকা। ভেবে দেখুন, সেই যুগে ১২ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ বিপুল এক অর্থরাশি। অথচ তারপরও মুখ খুবড়ে পড়তে হল! সারা দেশে তুমুল তোলপাড় হল। কারণ, এই ব্যাঙ্ক শুরু হওয়ার পরপরই জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানিকে নিজ দায়িত্বে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা ঋণ দেন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর দ্বারকানাথ। কিন্তু কোনও ভাবেই সময়ের মধ্যে আর সেই ঋণ পরিশোধ করল না জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানি। আর এখান থেকেই দেউলিয়ার হওয়ার উপাখ্যান শুরু। জলে গেল সাধারণ মানুষের কষ্টের টাকা।

কিন্তু, ব্যবসায় হাত পাকানো জমিদার বাড়ির ছেলে প্রিন্স দ্বারকানাথ কেন এই ঋণটি মঞ্জুর করতে গেলেন? তাঁর মতো বিচক্ষণ ব্যবসায়ীর তো এত বড় ভুল হওয়ার কথা না! আর এখানেই আসছে দ্বারকানাথের ইংল্যান্ডেশ্বরী ও গোরা সাহেবদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘিঁর তত্ত্ব।

রানি ভিক্টোরিয়ার জার্নাল থেকে জানা যায়, ১৮৪২ সালেরই ৮ জুলাই দ্বারকানাথকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন রানি। সেদিন ভিক্টোরিয়া তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, “এই ব্রাহ্মণ দারুণ ইংরেজি বলেন, দারুণ বুদ্ধিমান ও বেশ আকর্ষণীয় মানুষ”। এখানে বলে রাখা ভাল, দ্বারকানাথের বিলাসবহুল জীবনযাপন, বিরাট সম্পত্তি ও রাজারাজড়ার মতো চালচলনের কারণেই তাঁকে ‘প্রিন্স’ সম্বোধন করা হত। এ ছাড়াও শোনা যায়, মহারানি ভিক্টোরিয়াও নাকি তাঁকে ‘প্রিন্স’ বলে সম্বোধন করতেন।

একটি উপনিবেশের রাজধানীর এক মহাবিত্তবান ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তির মহারানির এমন নৈকট্য তো মোটেই খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ, এ নেহাত ব্যক্তিগত সখ্য হতে পারে না। বরং বাণিজ্যিক স্বার্থটাই যে আসল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে ঘটনাও তাই। রানির পছন্দের পাত্র হওয়ার আগে দ্বারকানাথকে হতে হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ কাছের মানুষ। আর এসবের জন্যই বিবেচনাবোধ শিকেয় তুলে ঋণ দিতে হয়েছিল জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানিকে।

ইতিহাস বলছে, ১৮৩০ সালে এই সংস্থা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়। আর তখন থেকেই এই ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের দেউলিয়া হওয়ার যাত্রা শুরু। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৮ সালে গিয়ে লালবাতি জ্বলে গেল পরাধীন ভারতে প্রথম ভারতীয় উদ্যোগে তৈরি ব্যাঙ্কটিতে। এরপর ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথ তাঁর হাতে থাকা ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দেন। আর সেই অর্থে তিনি দ্বিতীয়বার ব্রিটেনে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁর জমিদারি ছেলেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারাও করে দেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৬ সালের ১ অগস্ট লন্ডনে মৃত্যু হয় প্রিন্স দ্বারকানাথের। যদিও মৃত্যুর আগেই তিনি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তবু দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর একেবারেই দিশাহারা ও অভিভাবকহীন হয়ে যায় ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। অবশেষে একাধিক ভুল সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন ধরণের বাধা-বিপত্তির কারণে ১৮৪৮ সালে মুছে যায় এক বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল উদ্যোগের অন্যতম প্রতীক।