মহারাষ্ট্রের রাজনীতি যেন ঘড়ির কাটা! ১২টার ঘর থেকে টিক টিক করে যাত্রা শুরু করলেও আবার ফিরে আসে সেই ১২-র ঘরেই। শনিবারের বারবেলায় মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে যা ফল এল, তাতে ঘড়ির কাটার মতো ফের ১২ ঘরে দাঁড়িয়ে রইল শিবসেনা। শুধু বদলে গিয়েছে মুখ। সেদিন ছিলেন উদ্ধব ঠাকরে, এখন একনাথ শিন্ডে। ২৩৪টি আসনে জেতা মহাযুতি জোটের সরকার গড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম অনুঘটক এখন শিবসেনা। বিজেপি ১৩২, শিবসেনা ৫৭ । যেমন ২০১৯-এ উদ্ধবের শিবসেনা দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক এমনই জায়গায়। সরকার গড়ার জন্য শিবসেনাকে প্রয়োজন ছিল বিজেপির। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন উদ্ধব। এবারও একনাথ শিন্ডে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার। নিজের আসন ছাড়তে নারাজ তিনি। এই পর্যন্ত চিত্রনাট্য ঠিকই ছিল। কিন্তু ‘কাহিনি মে টুইস্ট’ যোগ করলেন অজিত পাওয়ার। ৪১টি আসন নিয়ে বসে আছেন তিনি। শিন্ডে একটু বেগড়বাই করলেই অজিতকে নিয়ে অনয়াসেই সরকার গড়তে পারে বিজেপি। উদ্ধবকে নিয়ে যে বাধ্যবাধকতা সেদিন ছিল বিজেপির এবার আর তা নেই। তাহলে মুখ্যমন্ত্রী কুর্সিতে কে? শিন্ডে না ফড়ণবীস না অজিত পাওয়ার! উত্তর একমাত্র জানেন গণপতি বাপ্পাই। তবে, মারাঠাভূমে ওত সহজেই কি সিংহাসন মেলে? একবছর আগের পাতা ওল্টালেই বোঝা যাবে মহারাষ্ট্রের অঙ্ক কী কঠিন!
২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে বারে বারে উত্থান-পতন দেখা গিয়েছে। তবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ২০২২ সাল। গোটা দেশ তখন কয়েক মাস ধরে মহারাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী হবে সেখানে, তা নিয়ে উৎসাহ-প্রশ্নের শেষ ছিল না। কী এমন হয়েছিল ওই বছর?
২০২২ সালে হঠাৎ মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে মহা সঙ্কট দেখা দেয়। জুন মাসের ২১ তারিখ হঠাৎ উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার ৪০ জন বিধায়কদের নিয়ে “উধাও” হয়ে যান বিদ্রোহী একনাথ শিন্ডে। রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছন সুরাটে। কী হতে চলেছে, তা নিয়ে যখন জল্পনা তুঙ্গে, সেই সময় ‘নিখোঁজ’ বিধায়কদের ফোন করতে শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। মহারাষ্ট্রে ফিরে এসে আলোচনায় বসতে বলেন। এদিকে বিধায়ক ‘হাইজ্যাকে’র ভয়ে রাতারাতি চার্টার্ড বিমানে উড়িয়ে নিয়ে যান অসমের গুয়াহাটিতে। তাদের আশ্রয় দেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। সেখানে এক সপ্তাহ কাটানোর পর গোয়া ঘুরে রাজ্যে ফেরেন শিন্ডে শিবির।
ততক্ষণে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন উদ্ধব ঠাকরে। অন্যদিকে, বিদ্রোহী একনাথ শিন্ডের শিবির নিজেদের আসল শিবসেনা বলে দাবি করে। গড়া হয় নতুন দল। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে একনাথ শিন্ডে গড়েন নতুন সরকার, নিজে বসেন মুখ্যমন্ত্রী পদে। এদিকে আসল-নকলের লড়াই গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। আদালতেও মামলা লড়ে নিজেদেরই ‘আসল শিবসেনা’ বলে প্রমাণিত করেন একনাথ শিন্ডে।
শিবসেনার ধাক্কা সামলানোর আগেই একই হাল হয় এনসিপিরও। ঘর ভাঙে শরদ পওয়ারের। একনাথ শিন্ডের দেখাদেখি অজিত পওয়ারও ৮ বিধায়ককে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। যোগ দেন মহাযুতি শিবিরে। এবার সেই মহাযুতির প্রথম পরীক্ষা ছিল। আর তাতেই একশোয় একশো।
এবার জোটের অন্দরে লড়াই মুখ্যমন্ত্রীর গদি নিয়ে। বিজেপির পছন্দ যে দেবেন্দ্র ফড়ণবীস, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফড়ণবীস নিজে জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানালেও, তাঁর মা-স্ত্রীর কণ্ঠে কিন্তু শোনা গিয়েছে আত্মবিশ্বাস-গর্বের সুর। যেন তারা জানেন যে ঘরের মানুষটাই মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন।
অন্যদিকে, একনাথ শিন্ডেও জমি ছাড়তে নারাজ। সূত্রের খবর, শিন্ডে দাবি করেছেন মহারাষ্ট্রে জয়ের নেপথ্যে কাজ করেছে লড়কি-বেহনা যোজনা, যা তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত। সুতরাং সাফল্যের কৃতিত্ব ও পুরস্কারও প্রাপ্য তাঁরই। তাই মুখ্যমন্ত্রী পদ দেওয়া হোক তাঁকে। যদিও সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি শুধু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সিদ্ধান্ত নেবেন যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন।
অজিত পওয়ারই বা পিছিয়ে থাকেন কেন। সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি না জানালেও, তাঁর নামে পোস্টার পড়েছে মুম্বই সহ রাজ্যের একাধিক প্রান্তে। এনসিপির নেতারা চাইছেন অজিতকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে।
তবে ভুললে চলবে না, মহাযুতির আগেও ছিল একটি জোট। ২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ জোটের অংশ ছিল অবিভক্ত শিবসেনা। সেই নির্বাচনে বিজেপি ১০৫টি আসনে জয়ী হয়। অবিভক্ত শিবসেনা পেয়েছিল ৫৬টি আসন। ভোটের ফল প্রকাশের পরই মুখ্যমন্ত্রীর গদি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। উদ্ধব ঠাকরে দাবি করেন, জোটের যুক্তি হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়েই। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদ দেওয়া হবে। আড়াই বছর পর মুখ্যমন্ত্রী বদল হতে পারে। কিন্তু বিজেপি এই দাবি অস্বীকার করে। কোনওভাবেই মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে রফা না হওয়ায়, শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে বেরিয়ে যান উদ্ধব ঠাকরে।
এই সুযোগেরই যেন অপেক্ষায় বসেছিল এনসিপি, কংগ্রেস। উদ্ধব ঠাকরেকে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তৈরি হয় মহা বিকাশ আগাড়ি। এদিকে, যখন উদ্ধবের নাম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করছে আগাড়ি জোট, সেই সময়ই তড়িঘড়ি দেবেন্দ্র ফড়ণবীসকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে দেওয়া হয়। রাখঢাক গুড়গুড়ের মাঝেই ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর সাতসকালে রাজভবনে হাজির হন দেবেন্দ্র ফড়ণবীস। রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারির কাছ থেকে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন।
সেই সময় আরেক চমকও ছিল। ফড়ণবীসের সঙ্গে ছিলেন অজিত পওয়ার! হ্যাঁ, ২০২২ সালে প্রথম নয়, তার আগে ২০১৯ সালেও কাকা শরদ পওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এনসিপি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন অজিত। সেই সময়ও তাঁকে উপমুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বই দেওয়া হয়। কিন্তু ফড়ণবীসের মুখ্যমন্ত্রী পদে স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫ দিনের। সুপ্রিম কোর্ট ফ্লোর টেস্ট বা আস্থা ভোটের নির্দেশ দেন। ভোটে না গিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইস্তফা দেন দেবেন্দ্র ফড়ণবীস।
কোন অঙ্কে রাতারাতি মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়ে বসেছিলেন ফড়ণবীস, তা এখনও কারোর কাছে স্পষ্ট নয়। সরকারের অবর্তমানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সেই নিয়মের ধারও ধারেননি ফড়ণবীস। রাতারাতি দাবি করেন যে সরকার গড়ছেন তাঁরা। যদিও শেষ পর্যন্ত ফড়ণবীসের দাবি ধোপে টেকেনি।
এনডিএ সরকারের পতন হতেই নতুন সরকার গড়ে মহা বিকাশ আগাড়ি। মুখ্যমন্ত্রী হন উদ্ধব ঠাকরে। ওদিকে, এনডিএ জোট ছেড়ে আবার কাকার ছত্রছায়ায় ফিরে আসেন অজিত পওয়ার। রাতারাতি ফের উপমুখ্যমন্ত্রী হন অজিত।
শিবসেনা, এনসিপির ভাঙন, লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচন পার করে, ২ বছর পর মহাযুতি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ২০১৯ সালে উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী পদের যে দাবি জানিয়েছিলেন, আজ সেই দাবিই জানাচ্ছেন একনাথ শিন্ডে। তার দাবি পূরণ হয় কি না, তা জানা যাবে জোটের আলোচনার পরই। আর দাবি যদি পূরণ না হয়, তাহলে একনাথের ভবিতব্যও কি উদ্ধব ঠাকরের মতোই হবে? এই প্রশ্ন উঠছে বারবার।