নয়া দিল্লি: ইন্ডিয়া জোটের তৃতীয় বৈঠক শেষ হওয়ার পরই বিহারে ফের পক্ষ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। ৩১ অগস্ট, মুম্বইয়ে ওই বৈঠকের পরই নীতীশ বুঝতে পেরেছিলেন, বিজেপি ছেড়ে লালুপ্রসাদ এবং কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোটা তাঁর বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল। তাই, নীতীশ কুমার জেডিইউ-এর ভিতর সঞ্জয় ঝা, অশোক চৌধুরী এবং বিজয় চৌধুরীর মতো বিজেপিপন্থী নেতাদের মন খতিয়ে দেখা শুরু করেছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আগের ব্যবস্থা কি খারাপ ছিল?” তাদের সঙ্গে গভীর আলোচনার পরই, পক্ষ পরিবর্তনকে বড় রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করেছলেন নীতীশ। তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়েছিলেন তিনি। সূত্রের মতে, বিজেপির সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সঞ্জয় ঝাকে। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তিনি গোপনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে আলোচনা করা শুরু করেছিলেন।
প্রতারিত বোধ করছিলেন নীতীশ
আসলে, আরজেডি আর জেডিইউকে একসঙ্গে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল জেডিইউয়ের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি লালন সিংয়ের। নীতীশ কুমারকে বিরোধী জোটের নেতা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন আরজেডি সুপ্রিমো লালু প্রসাদ। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় বৈঠক চলাকালীন, বেঙ্গালুরুর রাস্তায় নীতীশের বিরুদ্ধে পোস্টার এবং হোর্ডিং পড়েছিল। ইন্ডিয়া জোটের তৃতীয় বৈঠকে আহ্বায়ক হিসেবেও নীতীশের নাম পর্য়ন্ত উল্লেখ করা হয়নি। সেইসঙ্গে এই বৈঠকে রাহুল গান্ধীকে জোটের নেতৃত্ব দিতে বলেছিলেন লালুপ্রসাদ। নীতীশ বুঝতে পেরেছিলেন, লালুপ্রসাদ এবং কংগ্রেস তাঁকে নিয়ে খেলা করছে। তাই তিনি লালন সিংকে পাশ কাটিয়ে, দলে অশোক চৌধুরী, সঞ্জয় ঝা এবং বিজয় চৌধুরীকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন।
অমিত শাহের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সঞ্জয় ঝা
সেপ্টেম্বরেই জেএনইউ-এর বন্ধুদের সহায়তায় অমিত শাহের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেছিলেন সঞ্জয় ঝা। জেএনইউয়ের যে প্রাক্তন ছাত্ররা আজ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তা, তাদের কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর, প্রয়োজন ছিল বিজেপি-জেডিইউ মিলনে সবথেকে বড় বাধা, লালন সিং-কে দূর করা। জেডিইউ-এর প্রাক্তন সভাপতি লালু প্রসাদ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তাই বিজেপির আস্থা অর্জনে, লালন সিংকে সর্বভারতীয় সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
লালন সিংয়ের অপসারণ
পটনায় বৈঠক হলে, জেডিইউ-এর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারেন লালু। এই আশঙ্কায় দিল্লিতে জেডিইউয়ের জাতীয় পরিষদ ও কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক ডাকা হয়। সেখানেই জাতীয় সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় লালন সিংকে। দলের সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নেন নীতীশ। পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল বিজেপি। লালন সিংকে সরানোর ফলেই বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়েছিল, নীতীশ সত্যিই আরজেডি ছেড়ে আবার বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে চান। সঞ্জয় ঝা নিয়মিত অমিত শাহের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। সময়ে সময়ে এর অগ্রগতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকেও জানানো হয়। অপারেশন বিহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দুবার বিহার সফর বাতিল করতে হয়েছে। অপারেশন বিহার শেষ হওয়ার আগে, প্রধানমন্ত্রী বিহারে পৌঁছলে, তাঁর বক্তৃতায় নীতীশ কুমার সম্পর্কে নেতিবাচক কথা তে হত। তা এড়াতেই কৌশলি অহস্থান নিয়েছিল বিজেপি।
জোটের চতুর্থ বৈঠক, কফিনে শেষ পেরেক
ইন্ডিয়া জোটের চতুর্থ বৈঠকে, জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ কেজরীবাল যখন মল্লিকার্জুন খাড়্গের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তখনই নীতিশ কুমারের ধৈর্যের সব বাধ ভেঙে গিয়েছিল। বৈঠকে নীরব ছিলেন লালুপ্রসাদ ও তেজস্বী। জোটের চতুর্থ বৈঠক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় কাউন্সিলের সভা ডেকে লালন সিংকে জাতীয় সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেন নীতীশ।
নীতিশের প্রতি নরম বিজেপি
লালন সিং-এর অপসারণের পরই, বিহার বিজেপির সভাপতি সম্রাট চৌধুরীকে ডেকে জেপি নাড্ডা এবং অমিত শাহ বলেছিলেন, নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে খুব বেশি আক্রমণাত্মক হওয়ার দরকার নেই। রাজ্যের নেতারা যাতে অপারেশন বিহার সম্পর্কে কোনও আভাস না পায়, তাও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
আরজেডি-কে জেডিইউ-এর জবাব
একই সময়ে, রাম মন্দিরের বিরুদ্ধে আরজেডি-র বক্তব্যের কড়া জবাব দিতে শুরু করেছিল জেডিইউ। পাশাপাশি, শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে তেজস্বীর মুখ সরাতে শুরু করেছিল নীতীশ সরকার। চন্দ্রশেখরকে শিক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আরজেডিকে আরও চটান নীতীশ। পুরোটাই ছিল একটি সুপরিকল্পিত কৌশলের অংশ। ২৪ জানুয়ারি কর্পুরী ঠাকুরের জন্মশতবর্ষে, পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি কথা বলে নীতীশ তাঁর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রশংসাও করেন।
বিধায়কদের মন পরীক্ষা করেন অশোক চৌধুরী
জেডিইউ সূত্রে জানা গিয়েছে, কিছু বিধায়কের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে তাদের মন পরীক্ষা করেছিলেন অশোক চৌধুরী। তাদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি তিনি নীতীশ কুমারকে জানিয়েছিলেন। তবে, দলের কাউকে পক্ষ পরিবর্তনের বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত দেননি নীতীশ।
জেডিইউ ও বিজেপির বোঝাপড়ার কার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
জেডিইউ-বিজেপি বঝাপড়ায়, সঞ্জয় ঝা দিল্লির কিছু অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ সরকারি কর্তাদের সাহায্য নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, জেপি নাড্ডা তাঁর এক বন্ধুকে দিয়ে নীতিশ কুমারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন বলে জানা গিয়েছে। ওই ব্যক্তি মধ্যপ্রদেশে কর্মরত।
মহাজোট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কৌশল
আসলে, লালুপ্রসাদের সঙ্গে গেলে তাঁর উত্তরাধিকার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে, এটা নীতীশ ভালই বুঝেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের পরই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেবেন লালুপ্রসাদ য়াদব। তাই তাঁর রাজনীতির শেষ ইনিংস খেলতে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে আগ্রহ দেখান নীতিশ কুমার। কিন্তু, মহাজোট ছাড়ার জন্য অজুহাত লাগত জেডিইউ-এর। বিহারে ১৭টি লোকসভা আসনের দাবি করা বা কেসি ত্যাগীর ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাকে অযৌক্তিক বলা, সেই কৌশলের অংশ ছিল।
নীতীশ কুমার বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ
বিজেপির জন্য়ও নীতীশ কুমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রাম্প কার্ড। পশ্চাৎপদ এবং অত্যন্ত পশ্চাৎপদ মানুষদের মধ্যে যে লালু-বিরোধী ভোট রয়েছে, তা নীতীশ দিয়ে ঘরে তোলার কৌশল তৈরি করেছে বিজেপি। কর্পুরী ঠাকুরকে ভারতরত্ন প্রদানও সেই কৌশলের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।