মেদিনীপুরের মেদিনী দখলে ঘাম ছুটিয়েছে শাসক-বিরোধী, শেষ হাসি কার?
টিভি নাইন নির্বাচনী ইন্টেলিজেন্স ও রিসার্চ উইংয়ের মতে, নন্দীগ্রাম ছাড়াও দ্বিতীয় দফায় তাৎপর্যপূর্ণ আসন হচ্ছে চণ্ডীপুর, সবং, ডেবরা, খড়গপুর সদর।
কলকাতা: বিক্ষিপ্ত অশান্তি দূরে সরিয়ে রাখলে বঙ্গে প্রথম দফার ভোট (West Bengal Election 2021) মোটের ওপর শান্তিতেই মিটেছে। সারা বাংলার নজর এখন পয়লা এপ্রিলে। আরও নির্দিষ্ট করলে বাংলা তাকিয়ে নন্দীগ্রামে। দ্বিতীয় দফার ভোটে নন্দীগ্রামে দুই হেভিওয়েটের লড়াই। একে ওপরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কার্যত প্রশ্নের মুখে ফেলে একে ওপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী। টিভি নাইন নির্বাচনী ইন্টেলিজেন্স ও রিসার্চ উইংয়ের মতে, নন্দীগ্রাম ছাড়াও দ্বিতীয় দফায় তাৎপর্যপূর্ণ আসন হচ্ছে চণ্ডীপুর, সবং, ডেবরা, খড়গপুর সদর।
চণ্ডীপুর: পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের গা ঘেঁষেই চণ্ডীপুর বিধানসভা। এখানে তৃণমূল টিকিট দিয়েছে টলিউডের তারকা সোহম চক্রবর্তীকে। অন্যদিকে বিজেপি টিকিট দিয়েছে পুলক কান্তি গুড়িয়াকে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হয়েছেন আশীষ কুমার গুচ্ছাইৎ। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বড়জোড়া আসন থেকে লড়েছিলেন সোহম। কিন্তু তিনি সেখানে ৬১৬ ভোটে হেরে যান। চণ্ডীপুরে অবশ্য গত বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিলেন ঘাসফুল প্রার্থীই। তৃণমূল প্রার্থী অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য গত নির্বাচনে ৯ হাজার ৬০০ ভোটেরও বেশি ব্যবধানে সিপিএম প্রার্থী মঙ্গলচাঁদ প্রধানকে হারিয়েছিলেন। তবে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কাঁথি লোকসভার অন্তর্গত এই আসনে বিজেপির ভোট শতাংশ বাড়লেও এগিয়ে ছিলেন শিশির অধিকারী। বিজেপি প্রার্থী দেবাশীষ সামন্তর থেকে এই আসনে ১৫ হাজার ৪২৭ ভোটে এগিয়েছিলেন শিশির। যদিও এই বিধানসভা নির্বাচনে শুভেন্দু থেকে শুরু করে শিশির সকলেরই পদ্মযোগ ঘটেছে। এই বিধানসভা কেন্দ্রে ১১ শতাংশ ভোটার মুসলিম, তফসিলি জাতির ভোটার রয়েছেন ১২ শতাংশ। তফসিলি উপজাতি ভোটারের সংখ্যা অত্যন্ত কম।
সবং: ৬ বার বিধানসভা নির্বাচনে সবং আসন থেকে ভোটে জিতেছেন মানস ভূঁইয়া। তবে প্রত্যেক বারই কংগ্রেসের টিকিটে। ১৯৮২, ১৯৮৭, ১৯৯১, ২০০৬, ২০১১ ও ২০১৬ এই ৬ বিধানসভায় মানস জয় পেয়েছিলেন। ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যাবিনেটেও মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৬ সালে তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেন মানস। এরপর ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ২০১৭ সালে উপ নির্বাচনে এই আসন থেকে তৃণমূলের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মানস ভূঁইয়ার স্ত্রী গীতা ভূঁইয়া। এ বার তৃণমূল এই বিধানসভা আসনে টিকিট দিয়েছে মানস ভূঁইয়াকে। পাল্টা বিজেপির হয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন অমূল্য মাইতি। এই আসনে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হয়েছেন চিরঞ্জীব ভৌমিক। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন মানস ভূঁইয়া। যার মাধ্যমে ৪৯ হাজার ১৬৭ ভোটে জিতেছিলেন তিনি। সে বার নির্বাচনে তৃণমূলের নির্মল ঘোষ পেয়েছিলেন ৩৬ শতাংশ ভোট। বিজেপির প্রার্থী কাশীনাথ বোস পেয়েছিলেন ৩ শতাংশ ভোট। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট শতাংশ এই কেন্দ্রে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিজেপি পেয়েছিল ৪১ শতাংশ ভোট। তৃণমূল পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ ভোট। এই আসনে তফসিলি জাতির ভোটাররা রয়েছেন ১২ শতাংশ, তফসিলি উপজাতি ভোটার ৬ শতাংশ। মুসলিম ভোটার ৮ শতাংশ।
ডেবরা: পশ্চিম মেদিনীপুরের এই আসনে দুই প্রাক্তন আইপিএসের ভোটের লড়াই। একদিকে তৃণমূল টিকিট দিয়েছে হুমায়ুন কবিরকে। অন্যদিকে বিজেপি টিকিট দিয়েছে ভারতী ঘোষকে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ঘাটাল কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়েছিলেন দীপক অধিকারী। অন্যদিকে বিজেপি টিকিটি দিয়েছিল ভারতী ঘোষকে। ভোটে জিতেছিলেন অভিনেতা দেব। ২০২১ সালেই অবসর নেওয়ার কথা ছিল হুমায়ুন কবিরের। কিন্তু তার আগেই অবসর নিয়ে তৃণমূলের টিকিটে ডেবরা থেকে লড়ছেন হুমায়ুন কবির। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে এই আসন থেকে জিতেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী সেলিমা খাতুন। তিনি বামপ্রার্থী জাহাঙ্গির করিমকে ভোট হারিয়েছিলেন। সেলিমা পেয়েছিলেন ৪৮ শতাংশ ভোট, অন্যদিকে জাহাঙ্গির পেয়েছিলেন ৪২ শতাংশ ভোট। তৃণমূল জিতেছিল ১১ হাজার ৯০৮ ভোটে। বিজেপি মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিল এই আসনে। কিন্তু ২০১৯ বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে এই আসন চলে যায় বিজেপির দখলে। এই আসনে বিজেপি পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ ভোট, তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪২ শতাংশ ভোট। এই আসনে তফসিলি ভোটারের সংখ্যা ১৩ শতাংশ, তফসিলি উপজাতি ভোটারের সংখ্যা ১১ শতাংশ। এই আসনে মুসলিম ভোটার রয়েছেন ১০ শতাংশ।
খড়গপুর সদর: ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে যে তিনটি আসনে বিজেপি জিতেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল খড়গপুর সদর। এই আসনে বিজেপি থেকে জিতেছিলেন রাজ্য় সভাপতি দিলীপ ঘোষ। পরবর্তীকালে দিলীপ ঘোষ সংসদে নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর এই আসনে উপ নির্বাচনে জেতেন তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপ সরকার। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে খড়গপুর সদর আসনে তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন বিদায়ী বিধায়ক প্রদীপ সরকার। বিজেপি টিকিট দিয়েছে অভিনেতা হিরন চট্টোপাধ্যায়কে। সংযুক্ত মোর্চা এই আসনে প্রার্থী করেছে রিতা শর্মাকে। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন দিলীপ ঘোষ। তিনি হারিয়েছিলেন ৬ বারের বিধায়ক জ্ঞানসিং সোহন পালকে। ২০১৬ নির্বাচনে জ্ঞানসিং পেয়েছিলেন ৩৫ শতাংশ ভোট। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে দিলীপের ভোট ব্যবধান ছিল ৬ হাজার ৩০৯। ভোটের বিচারে তৃতীয় হয়েছিলেন রামপ্রসাদ তিওয়ারি। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ২২ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনে খড়গপুর সদর কেন্দ্রে তৃণমূল ও বিজেপির ভোটের ব্যবধান ছিল ৪৫ হাজার ১৩২। দিলীপ ঘোষ পেয়েছিলেন ৫৮ শতাংশ ভোট, তৃণমূলের মানস ভূঁইয়া পেয়েছিলেন ৩০ শতাংশ ভোট। তবে সব হিসেব বদলে যায় ২০১৯ সালের উপ নির্বাচনে। উনিশের উপ নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূলের প্রদীপ সরকার পেয়েছিলেন ৪৮ শতাংশ ভোট। বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৪ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৪ শতাংশ ভোট। এই কেন্দ্রে মুসলিম ভোটার ১৩ শতাংশ, তফসিলি জাতির ভোটার ১১ শতাংশ, তফসিলি উপজাতি ভোটার ৩ শতাংশ।
নন্দীগ্রাম: এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম একেবারেই ব্যাটেলগ্রাউন্ড। কারণ ভবানীপুর ছেড়ে এই আসনে প্রেস্টিজ ফাইটে নেমেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। আর লড়াই ‘নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নায়ক’ তথা ‘ভূমিপুত্র’ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে। তাই এ বারের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে গোটা বাংলার ফোকাসে নন্দীগ্রাম। এই আসনে সংযুক্তা মোর্চা সমর্থিক সিপিএম প্রার্থী ডিওয়াইএফআই নেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে শুভেন্দু অধিকারী ৬৬.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬২৩। অন্যদিকে বামপ্রার্থী আবদুল করিন শেখ পেয়েছিলেন ২৬.৫ শতাংশ ভোট। তিনি পেয়েছিলেন মোট ৫৩ হাজার ৩৯৩ ভোট। শুভেন্দু অধিকারী জিতেছিলেন ৮১ হাজার ২৩০ ভোটে। বিজেপি প্রার্থী সে বার পেয়েছিলেন স্রেফ ৫.৩২ শতাংশ ভোট। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থান হলেও এই আসন ছিল তৃমমূলের দখলে। এই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী দিব্যেন্দু অধিকারী পেয়েছিলেন ৬৩.১ শতাংশ ভোট, আর বিজেপি পেয়েছিল ৩০ শতাংশ ভোট। নন্দীগ্রামে ২৩ শতাংশ মুসলিম ভোটার, তফসিলি ভোট ১৬ শতাংশ, তফসিলি উপজাতির ভোট নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন: West Bengal Election 2021 LIVE: যতই নাটকবাজি করুন মমতা, হারাবই, হুঁশিয়ারি শুভেন্দুর