একুশের উপাখ্যান: হেরেও জিতলেন মমতা, ‘জায়েন্ট কিলার’ শুভেন্দু, বাম-কংগ্রেসের শেষ অধ্যায়

বহু অকল্পনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল একুশের ভোট

একুশের উপাখ্যান: হেরেও জিতলেন মমতা, 'জায়েন্ট কিলার' শুভেন্দু, বাম-কংগ্রেসের শেষ অধ্যায়
নিজস্ব চিত্র
Follow Us:
| Updated on: May 03, 2021 | 12:30 AM

কলকাতা: এ বারও ২৯৪ টি কেন্দ্রে তিনিই ছিলেন প্রার্থী। তিনি ‘খেলতে’ নামলেন। দলকে জেতালেন। কিন্তু, নিজে জিততে পারলেন না। দল ঐতিহাসিক জয় লাভ করলেও অধিনায়ক হেরে গেলেন, ভারতীয় রাজনীতিতে এমন দৃশ্য সত্যিই বিরল। যেই নেত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ২০০-র বেশি কেন্দ্রের মানুষ অন্যান্য প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জেতালেন, সেই নেত্রী নিজে অপরাজেয় থাকলেন না। এমন বহু অকল্পনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল একুশের ভোট।

তৃণমূলের ‘অপ্রত্যাশিত’ জয়

TMC Celebration

ছবি- টুইটার

তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন, জয় আসবে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ভোট শতাংশ এবং আসনের নিরিখে সেটা যে ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকেও টপকে যাবে, তা কেউ ভাবনে পারেননি। এতটাই বড় এবং অভাবনীয় তৃণমূলের এই জয়। যার একমাত্র কৃতিত্ব কেবল দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গত দেড় মাসে যে সময় প্রচার পুরোদমে চলছিল, তখন সম্ভবত একটাও দিন যায়নি যেদিন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, বা জেপি নাড্ডার আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়নি। বিজেপি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিল। তা সত্ত্বেও ২০০-র বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছে তৃণমূল। ১০ বছর কোনও রাজ্যে শাসনে থাকার পরও এত বড় জয়ে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার নজির খুব বেশি নেই দেশের রাজনীতিতে।

বিজেপির অভাবনীয় পরাজয়

BJP Won In Sitalkuchi

ফাইল ছবি

কিছুই বাকি রাখা হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণের কোনও সুযোগ ছাড়েনি বিজেপি। তৃণমূলের একাধিক নেতার উপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছিল কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিও। দুর্নীতি, অনুপ্রবেশ, কয়লা চুরি ইত্যাদিকে নির্বাচনী ইস্যু করে বিজেপি। একে একে আসতে থাকেন একের পর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি ও মোদী-শাহ। এই প্রথম কোনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে সর্বাধিক সভা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদীক। রাজ্যে ২০০-র বেশি আসন পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন অমিত শাহও। কিন্তু, এতে সায় দিল না বাংলার জনতা। ৮০ পেরতে পারল না বিজেপি। এই জনমত আরও একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। তৃণমূলের বিরুদ্ধে এ বার রণনীতি বদল করার কথা ভাবতে হতে পারে বিজেপিকে।

বিলুপ্ত বাম-কংগ্রেস, অধ্যায়ের অবসান

CPIM Will Contest In Congress Seat In Katowa

নিজস্ব চিত্র

পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেই সময় থেকে কোনও এমন ভোট আসেনি যেখানে বাম বা কংগ্রেস কোনও আসন পায়নি। প্রায় ৭০ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে এমন প্রথম ভোট দেখল বাংলা। যেখানে পুরোপুরি মুছে গেল এই দুই দল। যা কার্যত ছিল কল্পনাতীত। সংযুক্ত মোর্চার ভাগে আসন এসেছে মাত্র ১ টি। সেটাও পেয়েছেন ভাঙড়ের আইএসএফ প্রার্থী নউশাদ সিদ্দিকি। জনগণ এত স্পষ্টভাবে এর আগে কোনও জোটের বিরুদ্ধে রায় দেননি। আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত আরেকটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল কি না সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে আলিমুদ্দিনের। বাম ও কংগ্রেসেরও এই জোট নিয়ে পুর্নবিবেচনা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:  তৃণমূলের জয়, মমতার ‘হার’, ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নভঙ্গ বিজেপির, হাওয়া বাম

হেরেও জিতে গেলেন মমতা

Mamata Banerjee

ছবি- টুইটার

তিনি নিজে হারলেন, কিন্তু দলকে জেতালেন রেকর্ড মার্জিনে। বিজেপি ও তৃণমূলের ভোটের ফারাক প্রায় ১০ শতাংশ হলেও মাত্র হাজার দুয়েক ভোটে নিজে হেরে গেলেন মমতা। শেষবার তিনি হেরেছিলেন ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। সিপিএমের মালিনী ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। তারপর থেকে আর কোনও ভোটে হারেরনি মমতা। আর তিনি হারলেন এমন ভোটে, যেদিন সবচেয়ে বড় মার্জিনে নির্বাচনে জয়লাভ করল তাঁর দল। এ যেন ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস। বিশেষ করে রাজনীতিতে এত বছর কাটিয়ে নেওয়ার পর তাঁর হার একটা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, নন্দীগ্রামে লড়ার সিদ্ধান্ত তাহলে কি কেবল আবেগের বশে নিয়েছিলেন মমতা? তবু কথায় বলে, “শেষ ভাল যার সব ভাল তার।” এ ক্ষেত্রে বলাই যায়, ভোটের শেষটা ভালভাবেই হয়েছে তৃণমূলের।

জাত চেনালেন শুভেন্দুও

ছবি- পিটিআই

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৫০ হাজার ভোটে হারাতে না পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন শুভেন্দু। সেটা হয়তো পারেননি। তবে হারিয়ে তিনি দিয়েছেন। এ রাজ্যের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ভোটযুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামের মতো হাইভোল্টেজ সিটে বাস্তবেই ‘জায়ান্ট কিলার’ হয়ে উঠলেন তিনি। জয়ের ফারাক খুব বেশি না হলেও তাঁর এই জয়কে কোনও ভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবং তাঁকে হারিয়ে শুভেন্দুও একটা মিথ ভেঙে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রার্থী মমতা অপরাজেয় নন। তাঁকেও হারানো সম্ভব।

আরও পড়ুন: ‘কোথায় ভুল হল!’, বঙ্গে গেরুয়া ঝড়ের পথে বাধা হল যে কারণগুলি