সা য় ন্ত ভ ট্টা চা র্য
ঝুলে পড়েছে বারান্দার সিলিং। মনে হয় টোকা দিলেই গায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বিভিন্ন মানচিত্রের আকার নিয়েছে ইটের উপর চুন-প্যালেস্তারা ঝরে পড়া দেওয়ালগুলো। পাশেই হয়ত ঝুলছে পুরসভার নোটিস- ‘সাবধান! বিপজ্জনক বাড়ি’। তাই জীবন পথচারীর নিজ দায়িত্বে! ওই ভাঙাচোরা বাড়িগুলিতে কী ভাবেই বা রাতে শান্তির ঘুম হয় বসবাসকারীদের! সেটাও আরেক আশ্চর্যের বিষয়।
তিলোত্তমা শহরে এমনই নানা ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ দেখা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে। প্লাস্টার ফেটে বুকের লোহার পাঁজর বের করা সেইসব বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফুটপাত বদল করেন কোনও সাবধানী পথচারী। তবু কেন এই সব বাড়ি ভাঙা হয় না? নানা সময়ে এর জন্য আর্থ-সামাজিক যুক্তি দেন পুর-কর্তারা। দুয়ারে আরেকটা পুরভোট (Kolkata Municipality Election 2021)। বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এই বিপজ্জনক বাড়িগুলো নিয়েও প্রশ্ন কলকাতার নাগরিকদের মনে। কী বলছে পুরসভা?
বিপদ… খুব বিপজ্জনক বাড়ি:
শহর কলকাতার রাজপথ থেকে অলিগলি, চোখ মেললেই দেখা যায় ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ লেখা নোটিস লটকে আছে চুন-সুরকি খসা দেওয়ালে। ভাঙাচোরা দরজাও যেন প্রশ্ন করে আর কতদিন বইব ‘নিরাপত্তা’র দায়িত্ব? তবু সমাধান হয়নি, সমাধান হয় না! পথচলতি মানুষকেও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় ওই সব বাড়ির পাশ দিয়ে।
শহরে একের পর এক বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এদিকে শহরে টানা বৃষ্টি হলে বা ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়লে এই বিপজ্জনক বাড়িগুলি হয় আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে মূল মাথা ব্যথা। কিন্তু তার পরেও এই বাড়িগুলি সংস্কারের পথে একাধিক অন্তরায় থেকেই যায়।
কেন ভাঙাচোরা বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের বিপজ্জনক বাড়ি?
প্রথমেই আঙুল ওঠে কলকাতা পুরসভার উদাসীনতার দিকে। তার পর রয়েছে ভাড়াটে ও মালিকের চিরকালীন দ্বন্দ্ব। এই দুই কারণই মূলত বিপজ্জনক বাড়িগুলির সংস্কার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করা হয়। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকদের কথায়, “বিপজ্জনক বাড়ি কলকাতা থেকে নির্মূল করতে একাধিক পদক্ষেপ করা হয়েছিল। মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একাধিক বার্তাও। কিন্তু নানা অছিলায় বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দারা বা মালিকরা সেই কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সমস্যার সমাধান হয়নি”।
বিপজ্জনক বাড়ি নিয়ে কলকাতা পুরসভার হাতে যে তথ্য…
কলকাতা পুরসভার তথ্য বলছে, শহরের বুকে মোট ১৭০০টি পুরনো বাড়ি রয়েছে। যার মধ্যে ১০০টি বাড়ি নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় কলকাতা পুরসভার কর্তারা। বাড়ির বাসিন্দাদের স্থানীয় স্কুল, কমিউনিটি হল বা অন্যান্য ফ্লাড শেল্টারে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর পদক্ষেপ? পর পর বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়ার পর বছর কয়েক আগে পুর আইনে ৪১২ (এ) পাশ হয়। তাতে বলা হয়, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে মালিক যাতে নতুন বাড়ি তৈরি করতে পারেন, তার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে ফ্লোর এরিয়া রেশিও-য় ছাড় দেওয়া হবে মালিকপক্ষকে।
আর মালিক যদি বাড়ি না ভাঙেন তাহলে ভাড়াটেরা তা করবেন। ভাড়াটেরা না করলে পুরসভা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে এই কাজ করাবে। এমনই বলা হয়েছে ওই পুর আইনে। কিন্তু বহু কাজের মতো এখানেও নিয়ম নির্দেশ, আইন কেবল খাতায় কলমে রয়ে গিয়েছে। যার জেরে বিপজ্জনক বাড়িতেই প্রাণ হাতে করে এখনও বসবাস করেন বহু বাসিন্দা।
এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এতে সমস্যা হল, বললেই এই বাড়িগুলোকে বসবাসের অযোগ্য (কনডেমড) বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে বাড়ির মালিককে সুযোগ দিতে হয়। শুনানি করতে হয়। এদিকে প্রায় দু’বছর ধরে সে ভাবে শুনানিই করা যাচ্ছে না”। ওই পুরকর্তা আরও জানান, “১৪২ নম্বর পুর আইন এ ক্ষেত্রে আরও কার্যকর। আইন বলছে, ভাড়াটেরা যে জায়গা ভোগ করছেন, সেই সমপরিমাণ জায়গা ছাড় হিসেবে পেতে পারেন বাড়ি মালিক”। তবে সমস্যা কোথায়?
বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙা নিয়ে সমস্যা অনেক গভীরে। কারণ, বাড়ি মালিককে সুবিধা দিতে গিয়ে চারপাশের ছাড়ের জায়গা কমে যাচ্ছে। তাতে আবার দমকল আপত্তি করছে। ফলত গোটা ব্যাপারটায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু একের পর এক মৃত্যু থেকেও কি জট ছাড়ানোর উপায় বার হচ্ছে না?
লালবাজারের পুলিশ কর্তারা মনে করেন, পুরনো বাড়ির বাসিন্দারা সচেতন না হলে কোনও ছাড়েই কিছু হবে না। আর পুরসভা সূত্রে খবর, বেশিরভাগ বিপজ্জনক বাড়ি হয় মালিক- ভাড়াটে দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত। নাহলে আইনি জটিলতায় সংস্কারের পথ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। যে জট খোলার উপায় বছরের পর বছর খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন পুরকর্তারা।
ভাঙাবাড়ির ভেঙে পড়ার ভয়ে দিন কাটে প্রতিবেশীর:
এই বিপজ্জনক বাড়িগুলোকে নিয়ে সবথেকে যাঁরা উদ্বেগে থাকেন তাঁরা হলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ, টানা বৃষ্টি, ঝড়- ঝাপটা হলে আশপাশের বাড়িগুলির উপর তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আর তখনই তো ঘটে যায় বিপত্তি। শহরে বাড়ি ভেঙে হতাহতের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। পুরনো মহানগরে প্রাচীন বাড়ির সংখ্যা অন্যান্য শহরের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এমন অবস্থায় নতুন নতুন আইন শুধু পথ নয় বলে মনে করেন প্রশাসনিক কর্তারা। বিপজ্জনক বাড়িকে শহর থেকে নির্মূল করতে কলকাতা পুরসভাকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খুঁজে নিতে হবে বলেই তারা মনে করেন। কারণ, কারও উদাসীনতা অন্যদের বিপদের কারণ হতে পারে এই আশঙ্কা যখন থাকছে পুরো প্রশাসনকে করা হাতে এই বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন সমাজের সব মহলের কর্তারা।
গভীরে যাও:
এই বাড়িগুলি সংস্কারের ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা যেটা রয়ে যায়, তা অবশ্যই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কোনও মালিক যদি ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ ‘ট্যাগ’ মেলার পরে বাড়ি সংস্কার করার জন্য উদ্যোগী হন, তাহলে দুয়ারে হাজির হন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে থাকা “দাদারা”। এই অনিমন্ত্রিত অতিথিদের ‘দাবি-দাওয়া’ মেটাতে গিয়ে রীতিমতো ওষ্ঠাগত হয় বাড়ির মালিক বা ভাড়াটেদের প্রাণ। সেই আবদার মিটিয়ে তাই বাড়ি সংস্কার করতে অনেকেই পিছিয়ে আসেন। তাই ভাঙা বাড়ি পড়ে থাকে ভাঙা দশায়।
কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কারের জন্য একাধিক পুর আইন রয়েছে। এমনকী বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন বাড়ি তৈরীর সময় ইউনিট এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও ভাড়াটে এবং মালিকের মানসিকতা এবং কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কর্তাদের একাংশের সক্রিয়তার অভাবে শহরের বিপজ্জনক বাড়ির চরিত্র বদল হয় না।