সেই প্রাকযৌবন কাল থেকে মনোজদার (মনোজ মিত্র) সঙ্গে আমার সম্পর্ক। কিন্তু একটা কথা কোনও দিন বলে উঠতে পারিনি তাঁকে। স্কুল পাশ করার পর থেকেই ওঁর ঘনিষ্ঠ মহলে থাকার বড় ইচ্ছা হয়েছিল আমার। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছিলাম না সেই সুযোগ। তা যে আমায় কী অস্বস্তিতে ফেলেছিল সে কথা মনোজদাকে জানানোই হল না। তবে মঞ্চই তো আমাদের মিলিয়েছিল। সেই দিনটার কথা এখনও আমার স্মৃতিতে তরতাজা যেদিন আমায় তাঁর নাটকের একটা চরিত্রে জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন মনোজ স্যর। সে সময় ‘সাহেবের বাগান’ বলে একটি নাটক লিখেছিলেন তিনি।
সম্ভবত ১৯৭৭ সালে ‘মুক্তাঙ্গন’-এ প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল সেই নাটকটি। এখন যেমন অ্যাকাডেমিতে একটা ‘ডেট’ পাওয়ার জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়। সে সময় আমাদের নাটকের পীঠস্থান ছিল ‘মুক্তাঙ্গন’। তখন আমি একটু আধটু অভিনয় শুরু করেছি। নিজের একটা দলও গঠন করেছিলাম আমি। তখনই ‘সাহেবের বাগান’-এর একটি চরিত্র কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছিলেন না মনোজদা। আর ঠিক তখনই এক বন্ধুর মাধ্যমে যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে। আজ যদিও সব স্মৃতি। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে, এই তো মনোজ স্যরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর বেলগাছিয়ার বাড়িতে। যেতেই বললেন, ‘জমিদারের চরিত্র লিখেছি, সেই চরিত্রে অভিনয় করবে?’ এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এই ভাবেই যোগাযোগ। অদ্ভুত এক বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন আমার অভিনয় দেখে।
তখন মঞ্চে আমরা যারা অভিনয় করতাম, একসঙ্গে কাজ করতে করতে একটা পরিবার হয়ে উঠতাম। কারও পরিবারে কোনও সমস্যা হয়েছে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আসলে এখন অভিনেতারা মঞ্চে অভিনয় করে যে পারিশ্রমিক পান সেই সময় এ ভাবে কাজ হত না। তাই নাট্যদল, নির্দেশকের সঙ্গে আমরা এমন ভাবেই জড়িয়ে যেতাম ওটাই আমাদের জীবনের সব হয়ে উঠত। মনোজদাকে আমি কাছ থেকেও দেখেছি আবার দূর থেকেও দেখেছি। চিরকালই তাই ওনাকে নিজের আপনজনই ভেবে এসেছি। তাই মনোজ স্যরের থেকে বেশি মনোজদাই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আমার সঙ্গে সব ভাবনা-চিন্তা ভাগও করে নিতেন। মনোজদার এই আশা-ভরসার মানুষটা হতে পেরে নিজেকে তৃপ্ত লাগছে। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে থিয়েটারের সবাই মিলে আমরা চা খেতাম। সেই চায়ের আড্ডাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক বছর হয়ে গেল সেই আড্ডাটা এখন আর নেই। মঙ্গলবার মনোজদার বিদায়ের সময় পার্ক, পার্কের সামনের গল্প, দোতলা বাসে চড়ে যেতে যেতে বিভিন্ন ভাবনা, নাটকের আলোচনার কথাগুলোই বার বার মনে পড়ছিল। ৮বি, ২বি বাসে বসেই কত নাটক ভেবে ফেলতেন মনোজদা।
পরিচালক তপন সিনহা যখন মনোজদাকে বাঞ্ছারামের চরিত্রে তাঁকে অভিনয়ের কথা বলেছিলেন, তখন খানিকটা অবাকই হয়েছিলেন উনি। তপনদাকে বলেছিলেন আমি কিন্তু সেলুলয়েডে অভিনয়টা ঠিক বুঝি না। তবে তপনদা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন ছবিতে বাঞ্ছার চরিত্রে মনোজদা ছাড়া আর কাউকেই তিনি ভাবতে পারছেন না। এমন কত কত যে গল্পের সাক্ষী আমি বলতে বসলে রাত কেটে যাবে। মনোজদা দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। কলকাতার অনেক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ওঁর একটা কথা এখন বার বার মনে পড়ছে, মনোজদা কখনও বিশ্বাস করতেন না জীবনের মৃত্যু হয় বলে। সব সময় বলতেন জীবন সব সময় বেঁচে থাকে।