পার্টির থেকে এত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরও যাঁরা দলবদল করছেন, সেটা তাঁদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত: রণিতা ‘বাহামণি’ দাস

বঙ্গ রাজনীতির নিউ নর্মালে হাজির হয়েছে দু'টো শব্দ। 'বেসুরো' এবং 'দলবদলু'। এই পরিস্থিতিতে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলেন বাংলা টেলিভিশনের আরও এক পরিচিত মুখ। রণিতা 'বাহামণি' দাস। হঠাৎ কেন রাজনীতি? মানুষের পাশে থাকার জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার আবশ্যিকতা কতটা? TV9 বাংলার প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন বাহামণি সোরেন ওরফে রণিতা দাস।

পার্টির থেকে এত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরও যাঁরা দলবদল করছেন, সেটা তাঁদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত: রণিতা 'বাহামণি' দাস
গ্রাফিক: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Feb 13, 2021 | 1:31 PM

নতুন শুরু। অনেক অভিনন্দন…. কেমন আছেন?

খুব ভাল আছি।

হঠাৎ রাজনীতিতে কেন নাম লেখালেন?

বিগত ১০ বছর ধরে দিদির সঙ্গে আমি ওতপ্রতভাবে জড়িত। আমার বাড়িতে দিদি দু’বার এসেছেন। আর দিদির সঙ্গে ভালবাসার জায়গাটা কখনওই রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে শুরু হয়নি। উনি ভীষণ ‘বাহা’ দেখতে ভালবাসতেন। এপিসোড দেখে আমাকে বলতেনও। এতদিন আনঅফিসিয়ালি যুক্ত ছিলাম। ১০ বছরের এই সম্পর্ককে বলা যেতে পারে স্বীকৃতি দেওয়া হল… এই আর কি!

২০১১ তে ‘ইষ্টি কুটুম’-এ বাহামণি সোরেন সকলের ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠে। আর এক রাতে রণিতা দাস হয়ে যায় টেলিভিশন-স্টার। কিন্তু তারপর কেটে গেল ১০ বছর। আর তো আপনাকে দেখাই গেল না? কোথায় ছিলেন এতদিন?

এই সময়টায় আমি মুম্বইয়ে ছিলাম। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত অবশ্য আমি কলকাতাতেই ছিলাম। ২০১৫ থেকে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। গাইনোকোলজিক্যাল এবং স্পাইনে একটা সমস্যা ধরা পড়ে। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে শুট করতে পারতাম না। ডাক্তার বললেন, সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে। তাই ‘ইষ্টি কুটুম’ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। তারপর একটি রিয়্যালিটি শো, একটি ধারাবাহিকে অভিনয় করি। যদিও তা বেশিদিন চলেনি। তখনই আমার এবং সৌপ্তিক (হবু স্বামী)-এর মনে হয় ভবিষ্যতে যখন অভিনয় নিয়েই এগোতে চাই, তাহলে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। তাই দু’-বছরের জন্য আমরা মুম্বইয়ে চলে যাই। মুম্বইয়ে বেশ কিছু ‘অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ’ করি। বিক্রম ভাটের প্রোডাকশনে ‘আনঅ্যাফরেড-২’ নামে একটি সিরিজে অভিনয়ও করি। বলা যেতে পারে এটাই আমার জার্নি।

‘ইষ্টি কুটুম’ থেকে হঠাৎ করে সরিয়ে নেওয়ার কারণে, সেই সময় নানা রকম আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়। তারপর তেমনভাবে আর আপনাকে দেখা যায়নি। তাহলে কি সেই জটিলতার ভার এখনও আপনাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে?

না, সেই ভার এখন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। কারণ ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত, আমি চারটে মেগাতে না বলেছি। ‘কড়িখেলা’ নামে যে নতুন ধারাবাহিকে এই মুহূর্তে শ্রীপর্ণা অভিনয় করছে, তার প্রথম ‘কল’টা কিন্তু আমার কাছেই আসে।

‘না’ বলার কারণ কী?

কারণ মেগা করতে এখন একেবারেই আগ্রহী নই। ছবির কাজ করছি। খুব শিগগিরই আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাংলা ছবি রিলিজ করবে। হাতে আরও ২-৩টে কাজ আছে। আরও একটা চমকও আছে। আমার আর সৌপ্তিকের একটা ক্রিয়েশন খুব তাড়াতাড়ি সামনে আসতে চলেছে। তাই এত কাজের মাঝে ধারাবাহিকের চাপ নেওয়া এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া আমি টেলিভিশনের সেই ‘পিক’টা ছুঁয়ে দেখে নিয়েছি কেমন অনুভূতি হয়। তাই এবার আমি নতুন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই। এই সবকিছুই কিন্তু আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কেউ কাজ করতে দিচ্ছে না, এমনটা একদমই না।

রাজনীতির মঞ্চ কি আবারও লাইম লাইটে ফেরার একটা সহজ পথ বলে মনে হয়?

যাঁরা এমনটা ভাবছেন, তাঁদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা এটা। আমি কাজ করছি। এবং পারিশ্রমিকও পাচ্ছি। আমি যে সিনেমাগুলোব করছি সেগুলো ফ্রি-তে করছি না। মিমি, নুসরত কে যে ম্যানেজ করে সে আমাকেও ম্যানেজ করে। আমি যদি উপার্জন না করি আমার সংসারটা কীভাবে চলবে? আমার কাজগুলো পরে রিলিজ আছে তার মানে এই নয় যে আমি কাজ করছি না। শো করছি, ওপেনিং করছি। টাকা পাচ্ছি। যাঁদের মনে হচ্ছে লাইমলাইটে নেই, তাঁদের বলি, যদি লাইমলাইটে না থাকতাম তাহলে এত কাজের অফার আসছে কোথা থেকে? সুতরাং সব আছে। এত চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার মনে হয় রাজনীতি এমন একটা জায়গা যেখানে অনেকে আসতে চায়, কিন্তু আসতে পারে না। যাঁরা ভাবছেন আমাকে নিয়ে, তাঁদের বলব দাদা কাজও আছে, টাকাও আছে। আশীর্বাদ করুন নতুন যে পথে যোগ দিচ্ছি , সেই কাজটা যেন ভালভাবে করতে পারি।

রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কী সৌপ্তিক আর আপনার যৌথ সিদ্ধান্ত ছিল?

যে কোনও কাজ এলে অবশ্যই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। কিন্তু প্রাধান্য পায় ব্যক্তি-সিদ্ধান্তই।

এই মুহূর্তে বহু দুঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এক দল ছেড়ে অন্য দলে নাম লেখাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজনীতির ময়দানে পা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজের জন্য কেন সঠিক বলে আপনার মনে হল?

আমি ভয় পেয়ে বা ব্যক্তিগত কোনও লাভ-ক্ষতি বিচার বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তটা নিইনি। দশ বছর দিদির সঙ্গে থেকেছি, কাজ দেখেছি। মন থেকে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। পার্টির থেকে এত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরও যাঁরা দলবদল করছেন, সেটা তাঁদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত। তবে অন্য দলের কয়েকটি বিষয় আমি একদম মেনে নিতে পারি না। যেমন ধর্ম, জাতি নিয়ে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা। স্বাধীনতার এত বছর পর আমরা যদি ধর্ম দিয়ে, জাতি দিয়ে মানুষকে আলাদা করার চেষ্টা করি, আর সেটা যদি কোনও দলের আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে সেই দলকে আমি মন থেকেই মানতে পারব না।

ছাত্রজীবনে কখনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

না, আমি কখনও ছিলাম না। তবে আমার দাদু মদনমোহন রায় (মায়ের বাবা) সিপিএম-এর বড় নেতা ছিলেন। লক্ষ্মণ শেঠ আমার দাদুর হাতেই তৈরি। দিদিও এই কথাটা জানতেন। প্রথম যখন আমি একটি সরকারি অনুষ্ঠানে দিদির থেকে আমন্ত্রণ পাই, বাড়ির সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ দাদু রেগে যাবেন, তৃণমূলের অনুষ্ঠানে যাবে নাতনি! তবে সে দিন দাদু আমার ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তোমার যাওয়া উচিৎ। এটা একটা সম্মান।” হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল, শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে …

স্কুল লাইফে আমি ছিলাম, ক্লাসের ক্যাপ্টেন। এমনকি আমি যেখানেই কাজ করেছি, স্কুল হোক কিংবা কর্মক্ষেত্র, সব জায়গাতেই দাপটের সঙ্গে কাজ করেছি। তখন ‘ইষ্টি কুটুম’ শুরু হয়েছে। সত্তর হাজার টাকা দিয়ে একটা প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হই। কলেজে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল যে শুটিংয়ের জন্য রোজ ক্লাস করতে পারব না। অদ্ভুতভাবে পরীক্ষার দিন হলে সবাইকে খাতা দেওয়া হয়, কিন্তু আমাকে ২ ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয় আমার উপস্থিতির হার কম ছিল বলে। ফিরে এসে স্টুডিয়োতে খুব কেঁদেছিলাম। সেই কথা দিদির কানে যায়। তারপর দিদিই উদ্যোগ নিয়ে সেশনের মাঝে আমাকে অন্য কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। সত্যি বলতে দিদি না থাকলে আমার গ্র্যাজুয়েশনই শেষ হত না।

তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিয়ে আপনার পরিবারের মতামত কী?

আমি অনেক ছোটবেলা থেকে কাজ করছি। পরিবারের সবাই বরাবরই আমার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। সবসময় আমাকে একটাই কথা বোঝানো হয়েছে, আমার জন্য যেন অন্য কারও ক্ষতি না হয়।

তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর আপনি বলেন, “গত ১০ বছর ধরে দিদির সঙ্গে আছি। এতদিন পাড়া-প্রতিবেশীর মতো দূর থেকে সমর্থন করতাম। আজকে তৃণমূল পরিবারের সদস্য হলাম। সমস্ত কাজ, যা আমাদের দায়িত্বে দেওয়া হবে, আমরা যথাসম্ভব পালনের চেষ্টা করব।” কিন্তু টেলিভিশনে অভিনয়ের কারণে মানুষের ড্রইংরুমে অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছেন। মানুষের পাশে থাকার জন্য কী রাজনীতিতে যোগ দেওয়া বাধ্য়তামূলক হয়ে গিয়েছে?

আমি যেমন সিরিয়াল করে বাংলার মানুষের ঘরে-ঘরে পৌঁছেছি, তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য আমি পারিশ্রমিকও পেয়েছি। কিন্তু তাঁদের কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। তাঁদের শুধুমাত্র ‘এন্টারটেইন’ করেছি। তাঁদের কোনও ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বুঝতেও পারিনি, জানতেও পারিনি। সেই জন্য একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যারা দিন-রাত গ্রাসরুট লেভেলে কাজ করছে। সেই কাজটা বোঝা খুব দরকার। একদিন ইচ্ছে হলে বস্ত্র দান করলাম… তাতে তো তাঁদের জীবনের সমস্যার সমাধান হবে।

বাহা-র চরিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর কম ক্রিটিসিজ়মের মুখোমুখি হতে হয়নি আপনাকে। রাজনীতি তো আরও বৃহৎ জায়গা। একটা ভুল পদক্ষেপে উঠে আসবে হাজারো প্রশ্ন। আম-জনতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

কে, কী বলছে, আমি সেটা নিয়ে ভাবি না। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমার একটাই পন্থা, কোনও সময় যদি ভুল করি, আমি ক্ষমা চাইতে রাজি। মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। ভুল হলে আমি তা স্বীকার করতে রাজি।

এই নতুন ইনিংসের মাঝে, আপনার আর সৌপ্তিকের বিয়েটা তাহলে কবে হচ্ছে?

২০২২-এর আগে তো একদমই না। এখনও অবধি এটাই পরিকল্পনা। সবে ফিল্মের কেরিয়ার শুরু হচ্ছে। সঙ্গে আবার নতুন দায়িত্ব যোগ হল। তাই আপাতত সেই দিকেই মনোযোগ দিচ্ছি দু’জনেই।

গ্রাফিক -অভীক দেবনাথ