একসঙ্গে চারজন মেয়ে যদি বসে গল্প জোড়ে আর সেই গল্প যদি শুরু হয় সংসার-চাকরি নিয়ে, শেষ কিন্তু হয় শাড়ি আর গয়নায় এসে। মেয়েদের নামে এমন বদনাম সমাজ দিয়েই থাকে। কিন্তু চারজন মেয়ে একসঙ্গে গল্প জুড়লে যে অনেক সমস্যার সমাধান হয়, নতুন চাকরি-ব্যবসা সংক্রান্ত খোঁজ মেলে এবং অবশ্যই আত্মবিশ্বাস বাড়ে, সমাজের তা জানা আছে কি?
অতিমারি, গৃহবন্দি আমাদের ধ্যান-ধারণা, জীবনকে অনেকাংশে বদলে দিয়েছে। বাস্তব বোধ যেমন আমাদের মধ্যে প্রকট হয়েছে, তেমনই নিজের কিছু করার তাগিদ বেড়েছে। বেঁচে থাকতে গেলে, টিকে থাকতে গেলে কিছু না-কিছু সবাইকেই করতে হবে। প্রত্যেকের মধ্যেই বিশেষ কিছু গুণ থাকে। অভাব শুধু সময় আর সুযোগের। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও গৃহকর্তা কোনও সমস্যায় পড়লে কিংবা বাড়িতে কোনও অসুবিধে হলে মেয়েরা নির্দ্বিধায় নিজেদের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ উপুড় করে দিয়েছেন। এমনও অনেক সময় এসেছে যখন নিজের শখের গয়না খুলে দিতেও তাঁরা দু’বার ভাবেননি। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ভাবনাও। আর তাই এখন নিজের শখের জিনিসের বিনিময়ে নয়, বরং নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই মেয়েরা সাবলম্বী হতে চাইছেন। আরও অনেক বেশি ভাবে সমাজের পাশে, সংসারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
আর তাই-ই সুরমার তৈরি কুলের আচার আর এখন আর শুধু বাড়ির চৌহদ্দিতেই আটকে নেই, কৌটোবন্দি হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। লকডাউনে নিতান্ত শখেই ইউটিউব ঘেঁটে কেক বানাতে শিখেছিলেন সুদীপা। কিন্তু এখন দিনে চার-পাঁচখানা বার্থ ডে কেকের অর্ডার সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যেই নিজের জন্য বানিয়ে ফেলেছেন আলাদা কিচেন সেট-আপও। বরাবরই নিজের মতো কাস্টমাইজ় করে গয়না থেকে গিফট হ্যাম্পার নিজেই বানাতেন দিয়া। এমনকী বেশ কয়েকবার বানিয়ে দিয়েছে বন্ধুদেরও। কিন্তু ‘অনুরোধের আসর’ আকারে-আয়তনে এমনই বাড়তে শুরু করল যে, বর্তমানে নিজের একটি অনলাইন স্টোরই খুলে ফেলেছেন তিনি। পাশাপাশি কাজ শিখিয়েছেন আরও দুই পরিচিতজনকে। তিনজনের টিম নিয়েই এখন ফাটাফাটি ব্যবসা করছেন দিয়া।
যে মেয়ে আগে অঙ্কের নাম শুনলেই ভয় পেত, সেই এখন সারাদিন টাকা-পয়সা আর লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে ব্যস্ত। Organic Traffic, Post Reach, Boost Post, Group Invite, Facebook Live, Facebook Community-ডিজিটাল দুনিয়ার নতুন এইসব শব্দের সঙ্গে মেয়েদের পরিচিতি ঘটে গিয়েছে নিঃশব্দেই। এর জন্য অবশ্য তাঁদের কারোরই লম্বা-চওড়া ডিগ্রি নেই। আছে শুধু ইচ্ছে। আর সেই ইচ্ছের জোরেই কিন্তু তাঁরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। ‘কিছু একটা করতে হবে’—এই তাগিদ এখন সব মেয়েদের মধ্যেই। দিনের মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় মানুষ এখন কাটান সোশ্যাল মিডিয়ায়। ৮-৮০ সকলেই কিন্তু রয়েছেন সেই তালিকায়। সারাদিন ধরে শুধু যে সেখানে ‘Good Morning’ আর ‘শুভরাত্রির’ বার্তা/ স্টিকার আদান-প্রদান হচ্ছে তাই নয়, বরং সেখান থেকে জীবন-শিক্ষাও নিচ্ছেন তাঁরা। মনের এই বন্ধ দরজাগুলো আবারও খুলে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন মেয়েদের গ্রুপ। ফেসবুকে এখন এমন কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। যেখান থেকে তাঁরা স্বনির্ভর হচ্ছেন এবং নিজের ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকার রসদটুকুও পাচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সমস্যা হলে সমাধানের উপায় যেমন পাওয়া যায়, তেমনই বাড়ি-অফিসের চাপ সামলে Balanced lifestyle- টিপসও কিন্তু পাওয়া যায় এই সব গ্রুপের মাধ্যমেই।
যে সব মেয়েরা নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করেন, প্রায়ই তাঁদের কাছে নানা গ্রুপে অংশ নেওয়ার জন্য নোটিফিকেশন আসে। সব গ্রুপই যে নিছক ব্যবসার জন্য তৈরি হয়েছে, এমন কিন্তু নয়। নিজের মনের কথা খুলে বলার জন্যও কিন্তু বেশ কিছু গ্রুপ রয়েছে। যেমন ‘Women Untamed’-গ্রুপের অ্যাডমিন উপমিতা মজুমদার জানান, লকডাউনেই তিনি এই গ্রুপ তৈরি করেছেন। তখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-কিংবা আড্ডার কোনও সুযোগ ছিল না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম কালচারে ২০২০-তেও আমরা কেউ তেমন অভ্যস্ত ছিলাম না। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে মন হাঁপিয়ে উঠছিল। আর সেখান থেকেই কিন্তু এই গ্রুপের ভাবনা। বর্তমানে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬ হাজারের কাছাকাছি। এই গ্রুপে বেচা-কেনার তেমন চল নেই, কিন্তু একে-অপরের পাশে সব সময় রয়েছেন। সাজগোজ, রান্না, বেড়ানো, ফ্যাশন, শারীরিক সমস্যা, সম্পর্ক… নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি এই সব গ্রুপ থেকে কিন্তু পাওয়া যায় কাজের সুযোগও। রয়েছে কাজের প্রয়োজনে নিজের সিভি (Curriculum Vitae) পাঠানোর সুযোগও। সারাদিনের ব্যস্ত শেডিউলের পর মন হালকা করতে কিংবা একটু মন খুলে নিজের কথা বলতে পারার মত অনেক মেয়েরই কাছের বন্ধু ‘Women Untamed’। মাঝেমধ্যেই গ্রুপের সদস্যরা মিলে একসঙ্গে meet-up রাখেন, গ্রুপ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও করেন। নারী দিবসেই দারুণ একটি গেমপ্ল্যান রয়েছে এই গ্রুপের।
লকডাউনের বছর দুই আগেই যাত্রা শুরু ‘Womanhood’-এর। গ্রুপ অ্যাডমিন দেবস্মিতা কুমার ছিলেন তখন ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। দেবস্মিতার সঙ্গে রয়েছেন আরও ৫ মডারেটর। গ্রুপে নানা রকম পোস্ট চলতে থাকে। সমস্যার সমাধান, রান্নার রেসিপি, পোশাক, ক্রাউড ফান্ডিং থেকে শুরু করে পাত্র কিংবা পাত্রী চেয়ে পোস্ট—সবই হয় এক ছাদের তলায়। এছাড়াও গ্রুপের মাধ্যমে প্রচুর মেয়ে তাঁদের নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করেছেন। হরেক সম্ভারে ডালা সাজিয়ে এক-একজন আসেন। কারও কাছে যেমন থাকে মন মাতানো শাড়ি, আবার কারও কাছে থাকে লোভনীয় সব ব্যাগ। এ ছাড়াও যখনই গ্রুপের কোনও সদস্য আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন, তখনই কিন্তু ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে পাশে দাঁড়িয়েছেন বাকিরা। লকডাউনের সময়েও বেশ কিছু ফান্ড সংগ্রহ করে তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গ্রুপের তরফে বাচ্চাদের বই, খাতা, পেন্সিল, রং-সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সদস্যরা। বর্তমানে Womanhood-এর সদস্য সংখ্যা ১৬ হাজার।
লকডাউনে এমন সব মেয়েদের গ্রুপের রমরমা দেখে ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা দেবী প্রধান বসুর মনে হয়েছিল এমন একটা গ্রুপ যদি তিনি তাঁর অঞ্চলের মেয়েদের নিয়ে বানাতে পারেন তাহলে কেমন হয়। নিজস্ব একটি বুটিক রয়েছে দেবীর। সেখান থেকেই তিনি তৈরি করেন দেবীদির (নারী তুমি অনন্যা)- গ্রুপটি। বর্তমানে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ২০ হাজারের। ঝাড়গ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকার (গিধনি, বিনপুর, শিলদা, মানিকপাড়া, খড়গপুর) মেয়েরাই মূলত রয়েছেন এই গ্রুপে। এছাড়াও জামশেদপুর অঞ্চলের বেশ কিছু মহিলাও রয়েছেন। লকডাউনে প্রচুর মেয়ে কাজ হারিয়েছেন। বাইরে গিয়ে কাজের সুযোগ তেমন ছিল না। যে সব মেয়েরা গৃহশিক্ষকতা করতেন, তাঁদের অনেককেই কোভিড পরিস্থিতিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মেয়েদের সাবলম্বী করতেই এমন ভাবনা। এমনও কিছু মহিলা রয়েছেন যাঁরা স্মার্টফোনের সামান্য ব্যবহারটুকুও জানতেন না। তাঁরাও এখন ফেসবুক লাইভে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। নারী দিবসে মেয়েদের বিনামূল্যে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচী নিয়েছেন তাঁরা। যেখানে ফ্রি মেক-আপ থেকে শুরু করে, হাতের কাজ, কেক বানানো সবই শেখানো হবে। এছাড়ও মেয়েদের তৈরি নানা সামগ্রী নিয়ে প্রায় ৭০ জন মহিলা শান্তিকেতনের ধাঁচে বসিয়েছেন ‘লাল মাটির হাট’। এসবের পাশাপাশি বেশ কিছু সমাজসেবামূলক কাজেও অংশ নেন তাঁরা।
তবে কি লকডাউন আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম কোথাও গিয়ে মেয়েদের আরও বেশি কর্মব্যস্ত করে তুলেছে? কিছু একটা করার তাগিদ বেড়েছে? এ বিষয়ে সমাজকর্মী তথা অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বললেন, “অর্থ উপার্জন না করলে যে সম্মান নেই, তা ঠরে ঠরে বুঝিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের। গৃহবধূরা তাঁদের যোগ্য সম্মান পেলেন কই? ‘বাড়ির কাজ, ও তো সবাই পারে’, এমনই মানসিকতা রয়েছে আমাদের। এমনকী যাঁরা কর্মরতা, তাঁরাও কিন্তু একই প্রশ্ন করেন। যেখান থেকে বাকি মেয়েরা হীনমন্যতায় ভোগেন। অংশিক সময়ের কাজে সুযোগ বেড়েছে। তাগিদ বেড়েছে। বেড়েছে আর্থিক প্রয়োজনীয়তাও। আর তাই মেয়েরাও এগিয়ে আসছেন।”
আরও পড়ুন: Women’s Day 2022: আমি পেশাগতভাবে ডিজে… মিউজিক বাজাই, বেলেল্লাপনা করি না