সত্যি কথা বলতে, এসএস রাজামৌলি আজকের পরিচালক নন। অনেক সময় ধরেই তিনি ছবি তৈরি করছেন। আমি কোনওদিনও তেমন মনযোগ দিইনি লোকটার দিকে। এর অন্যতম কারণ, বিগত ১০ বছর ধরে তিনি বাণিজ্যিক ছবিই তৈরি করে এসেছেন। তবে যখন ‘মগধিরা’ তৈরি করলেন, আমি তাঁর কাজ দেখেছিলাম মুগ্ধ হয়ে। তিনি কিন্তু অন্যান্য পরিচালকদের মতো নন। বরং খুবই স্পেশ্যাল। অনেক আগে থেকেই ‘বাহুবলী’ তৈরির পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছিলেন রাজামৌলি। পরিচালনার ধরনে পরিবর্তন এনেছিলেন অনেকটাই। কেন এমনটা তিনি করেছিলেন, সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না। হঠাৎই ছবি তৈরির বাজেট বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ছবিতে অনেক অর্থ লগ্নি করতে পারবেন, এমন মানুষ খুঁজতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় তেলুগুতে অত বেশি বাজেটের ছবি তৈরি করার কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না। আমার মনে আছে, ‘বাহুবলী ১’ যখন মুক্তি পেল, তেলুগু ইন্ডাস্ট্রির এক হোমড়া চোমড়া প্রযোজক বলেছিলেন যে, এ ছবি তো ডাহা ফ্লপ করবে। তেগুলু বাজার থেকে অত টাকা উঠে আসবেই না। খুব বেশি হলে হয়তো ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করলেও করতে পারে।
তখন ১৫০ টাকা খরচ হয় ‘বাহুবলী’ তৈরিতে। এ কথা অন্য যে, পরবর্তীতে ‘বাহুবলী’ অনেক মুনাফা করেছিল। রাজামৌলি একজন অত্যন্ত দায়িত্ববান মানুষ। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন এবং সাফল্য দেখেছেন। এবং এই দুটি জিনিসই তাঁকে আরও বড় এবং এবং উন্নত হতে সাহায্য করেছে। ‘বাহুবলী’ পুরো খেলাটাই পাল্টে দিয়েছিল। বলিউডও ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল এবং নিজের চোখে চমৎকার হতে দেখেছিল। বলিউডে সবচেয়ে দামী বাজেটের ছবিগুলির তালিকায় আসে ‘কমবখত ইশক’, ‘হাউজ়ফুল’। তারকাদের অনেক টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে সেই সব ছবিতে। তাঁদের উপর অনেক খরচ করেছেন প্রযোজকরা। কিন্তু রাজামৌলি করলেন কী, তিনি অভিনেতাদের পারিশ্রমিক দিলেন কম এবং ছবি দেখতে যাতে দর্শকের ভাল লাগে, তাই মেকিংয়ে বেশি খরচ করলেন। সেটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। আমি ঝুঁকি বলছি কারণ, এ ভাবে আগে কেউ কাজ করেননি। আর বলিউড এতদিন দক্ষিণী ছবিগুলির রাইটস কিনে রিমেকটাই তৈরি করতে পেরেছে। কেবল সেটাই ভাবতে পেরেছে। তার বাইরে পারেনি।
আমি অন্য়ান্য তেলুগু ছবিকে কৃতিত্ব দিতে চাই না। এটা কেবলই রাজামৌলির জয়। তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ১৫০টি ছবি হয়। কোনওটাই রাজামৌলির মতো সাফল্যের জায়গায় যেতে পারেনি। যদি রাজামৌলির জন্ম গুজরাটে কিংবা হিন্দিভাষী কোনও রাজ্যে হত, তখন? সেখানেও একইভাবে তিনি সফল হতেন। তাই এক্ষেত্রে তেলুগু ছবি কিংবা এই ইন্ডাস্ট্রি আলাদা কৃতিত্বের দাবিদার নয়।
আমি বিশ্বাস করি, রাজামৌলির অনেক ধৈর্য এবং আবেগ। তিনি স্বপ্নকে সত্যি করার শক্তি রাখেন। অন্য কেউ হলে ৬ মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার প্রয়াস করতেন। কিন্তু রাজামৌলি বছরের পর-বছর অপেক্ষা করতে পারেন এবং করেছেনও। তার উপর তাঁর মধ্যে এমন এক শিশু লুকিয়ে আছে, যাঁর মাইথোলজি (পুরাণের গল্প) ভাল লাগে। ভারতীয় পুরাণের গল্প, তার চরিত্রদের তিনি ভালবাসেন।
একজন কীভাবে রাজামৌলির ছবিতে বর্ণনা করবেন?
আমি রাজামৌলির ছবির ভক্ত নই। আমি বাস্তবধর্মী ছবিতে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তবে রাজামৌলির ছবি তৈরির মধ্যে অভিনবত্ব এটাই, তিনি মহাভারত-রামায়ণ-এর মতো মহাকাব্য কিংবা পুরাণের গল্পকে ভয়ানক ভাল ভিজ়ুয়াল এফেক্টস দিতে পারেন। সাধারণ মানুষের আবেগকে স্পর্শ করতে পারেন। ফলে, যেটা হয়, প্রত্যেক স্তরের দর্শকের কাছে ছবি পৌঁছে যায় অনাসায়েই। দক্ষিণে এমনিতেই ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ছবি তৈরির সংখ্যা অনেক বেশি। রাজামৌলির বাবা লেখক মানুষ ছিলেন। ফলে ছোট থেকে পুরাণের প্রতি তাঁর ভালবাসা।
রাজামৌলির সঙ্গে আমার আলাপ ২০০০ সালে এবং ওঁর তৈরি ‘মগধিরা’ দেখে ছিটকে গিয়েছিলাম অনেক পরে। সেই সময় অনেক-অনেক টুইট করে বলেছিলাম, সেটি তেলুগু ছবির জগৎ পাল্টে দেবে। যখন আমাদের প্রথম আলাপ হয়, রাজামৌলি মাটিতে বসেছিলেন। অনেক কিছু নিয়ে কথা বলছিলেন। বললে অবাক হবেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি বাড়িতে বসবাস করেন রাজামৌলি। আজই কোনও আড়ম্বর নেই তাঁর। আমাকে ‘বাহুবলী’র গল্পটা তিনি বলেছিলেন। তাঁর সাধারণ জীবনযাত্রা দেখে আমি খুবই হতবাক হয়েছিলাম। না, সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষদের ভক্ত আমি নই। কিন্তু রাজামৌলির একাগ্রতা প্রখর। তুলনায় তাঁর ব্যক্তিজীবন উল্টো। মুম্বইয়ে এলে তিনি ইনোভা গাড়িতে ঘোরেন। সঙ্গে থাকেন না কোনও সহকারী। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আইসক্রিম খেতে চলে যান। আমি শুনেছি সেটাই নাকি তাঁর জীবনের একমাত্র আরাম-আয়েশ। একটি সরু বারান্দায় ‘বাহুবলী’র গল্প শুনিয়েছিলেন রাজামৌলি। এখনও পর্যন্ত সেই বাড়িটিতেই থাকেন রাজামৌলি।
জাপানে ‘বাহুবলী’র সাফল্য দেখে শিশুর মতো অবাক হয়েছিলেন রাজামৌলি। সেখানে কেন মানুষ ছবিটি দেখলেন? আমার মনে হয়, এক্কেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানকার দর্শকদের। রাজামৌলির বাজার এখন দুর্দান্ত। তেলুগু, তামিল, কন্নড়, মালায়ালাম, হিন্দি এবং অন্যান্য ভাষা – সবেতেই রাজামৌলি দুর্দান্ত পারফর্ম করছেন। যদি ‘পাঠান’-এর কথাই বলি, ‘বাহুবলী’র তেলুগু-তামিল-কন্নড়ের ব্যবসার তুলনায় ধারেকাছেও তো আসতে পারেনি। এখন ‘আরআরআর’ অন্য মাত্রা ছুঁয়ে ফেলল।
আপনারা শুনেছেন তো আমাদের ষড়যন্ত্রের কথা। আমরা নাকি লবি করেছি, টাকা দিয়েছি… এগুলো আমি বিশ্বাস করি না। কেন বলছি, কিনতেই যদি যেত, তা হলে হলিউডের বড় স্টুডিয়ো কিনে নিতে পারতাম। আসলে রাজামৌলির এই দৌড়টাকে অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। হিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘আরআরআর’ পশ্চিমে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। কত মানুষ টুইট করছেন। আমি জানি না তাঁরা আদৌ কোনওদিনও ভারতীয় ছবি দেখেছিলেন কি না।
রাজামৌলির ছবি তৈরির কৌশল কেমন?
বড়-বড় ফ্রেম, ফটোগ্রাফি এবং আর্ট ডিরেকশন। সিনেমা হলে দেখতে যে কারণে ভাল লাগে। বাস্তবধর্মী আবেগ নিয়ে কাজ করেন রাজামৌলি। গল্প বলার পদ্ধতি খুবই সহজ। দর্শককে খুব একটা মাথা খাটাতে হয় না। রাজামৌলির ছবিতে প্রযুক্তি অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
মানুষ রাজামৌলি কেমন?
বিশ্বাসকে সম্বল করে বড় লাফ দেওয়ার মানুষ রাজামৌলি। তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা রাজামৌলির একটি ছবি ২০০০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারে। ৫ বছর আগেও এমনটা কেউ কল্পনা করত পারেনি। রাজামৌলির সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির কারও বিরোধ নেই, বচসা নেই। তাঁকে নিয়ে কোনও গুজব নেই। কোনও বিতর্ক নেই। কেউ তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কিছুই বলেন না। কেউ তাঁর কাছের মানুষ হলে, চিরকালই তাঁর কাছের মানুষ হয়েই থেকে যান।
পরিচালক রামগোপাল ভর্মা’র বয়ানে